মেমসাহেবকে ভুলি কি করে? ওকে ভুলতে হলে নিজেকেও ভুলতে হয়, ভুলতে হয় আমার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। কিন্তু সে কি সম্ভব? আমি যদি উন্মাদ না হই, তাহলে তা কি করে হবে? আমার জীবনের অমাবস্যার অন্ধকারে ওর দেখা পেয়েছিলাম। কৃষ্ণপক্ষের দীর্ঘ পথযাত্রায় ও আমার একমাত্র সঙ্গিনী ছিল। কিন্তু পূর্ণিমার আলোয় ওকে পাবার আগেই ও পালিয়ে গেল। ও আমাকে সবকিছু দিয়েছে। কর্মজীবনে সাফল্য, সমাজজীবনে প্ৰতিষ্ঠা, প্ৰাণভর ভালবাসা-সবকিছু দিয়েছে। নিজে কিছুই তোগ করল না, কিছুরই ভাগ নিল না। সবকিছু রেখে গেল, নিয়ে গেছে শুধু আমার হৃৎপিণ্ডটা।
এই বিরাট দুনিয়ায় কত বিচিত্র আকর্ষণ ছড়িয়ে রয়েছে। মানুষের মনকে প্ৰলুব্ধ করার জন্য সম্পদ-সম্ভোগের বন্যা বয়ে যাচ্ছে দেশে দেশে। কত নারী, কত পুরুষ তা উপভোগ করছে। আমার জীবনেও সে সুযোগ এসেছে বার বার, বহুবার। স্বদেশে, বিদেশে সর্বত্র। কিন্তু পারিনি। মনের মধ্যে এমন জমাট-বাধা কান্না জমে আছে যে, আনন্দে-বাসরের কাছে গেলে আমি আঁতকে উঠি। দিল্লী, বোম্বে, কলকাতায় কত রসের মেলা বসে রোজ সন্ধ্যাবেলায়। কত বন্ধু-বান্ধব ও বান্ধবী সাদর আমন্ত্রণ জানান সে-উৎসবে, সে-রসের মেলায় অংশ নিতে। হয়ত সেসব উৎসবে উপস্থিত থাকি, হয়ত ঠোঁটের কোনায় একটু শুকনো হাসির রেখা ফুটিয়ে কাকলী রায় বা অনিমা মৈত্ৰকে আর এক গেলাস শ্যাম্পেন বা হুইস্কি এগিয়ে দিই কিন্তু মেতে উঠতে পারি না। ওদের মত। শুধু এখানে কেন? লণ্ডন, প্যারিস, নিউ ইয়র্কে? ওখানে তো সন্ধ্যার পর মানুষ মাটিতে থেকেও অমরাবতী-অলকানন্দায় বিচরণ করে। পরিচিত-পরিচিতার দল আমাকে হোটেল থেকে টেনে নিয়ে যায়, একলা থাকতে দেয় না। কিন্তু পারি কি ওদের মত আমরামতী-অলকানন্দায় উড়ে যেতে? পারি কি নিজেকে ভুলে যেতে? পারি না দোলাবৌদি, পারি না। সব সময় মনে হয় মেমসাহেব থাকলে কত মজা হতো।
ওরা কত ইচ্ছা ছিল আমার সঙ্গে দেশ-বিদেশে ঘুরবে। যখন ও আমার কাছে ছিল, তখন ওকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবার সামৰ্থ্য আমার ছিল না। অকৰ্মণ্য বেকার সাংবাদিক হয়ে ওকে নিয়ে কলকাতার রাস্তায় বেরুতেও ভয় পেতাম, লোকলজ্জায় পিছিয়ে যেতাম। আজ? আজ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। আজ ঐ চিরপরিচিত কলকাতার রাজপথে আমি যে-কোন মেয়েকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারি। আমি জানি কেউ আমার সমালোচনা করবে না বা করলেও সে বিশ্ব-নিন্দুকদের আমি ভয় করি না। কিন্তু আজ কোথায় পাব আমার মেমসাহেবকে? যে কলকাতার রাজপথ দিয়ে হঁটিতে হাঁটতে দুজনে স্বপ্ন দেখেছি। ভবিষ্যৎ জীবনের, আজ আমি সেই পথ দিয়েই এক এক ঘুরে বেড়াই। সকাল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পৰ্যন্ত ঘুরে বেড়াই। . ক্লান্ত হলে এক কাপ চা বা এক পেগ হুইস্কি নিয়ে বসে পড়ি, কিন্তু মেমসাহেবের স্মৃতিবিজড়িত পথের আকর্ষণ কাটিয়ে ঘরে ফিরতে পারি না। ভাবি, নিঃসঙ্গভাবে পথ চলতে গিয়েই একদিন মেমসাহেবের দেখা পেয়েছিলাম ভিড়ের মধ্যে ওকে হারিয়ে ফেলেছি। হয়ত পথে পথে ঘুরতে ঘুরতেই আবার ওর দেখা পাব। আমি জানি এই পৃথিবীতে আর একটা মেমসাহেব পাওয়া অসম্ভব। যদিও বা সবকিছুর মিল খুঁজে পাই, ওর ঐ অপারেশনের চিহ্ন তো পাব না।
মেমসাহেবকে পেয়ে বোধহয় মনে মনে বড় বেশি অহংকার হয়েছিল। বোধহয় সেই তরুণ প্ৰেমিকের মত ভেবেছিলাম–
জিস্ত পর ইনকিলাব আনে দে
কমসিনী পর শরাব আনে দে
এ খুদা, তেরী খুদাই পলটু দুঙ্গা
জরা লব তক শরাব আনে দে।
মরনে আর জিনে কা ফয়সালা হোগা।
জরা উনোক জবাব আনে দে।
হয়ত সেই তরুণ প্রেমিকের মত ভেবেছিলাম, আমার হৃদয়ে বিপ্লব আসুক, আমার ঐ প্রাক-যুবতীর যৌবন আসুক, ওর ঠোঁটে ভালবাসা আসুক, তারপর ভগবানের ভগবানত্ব ঘুচিয়ে দেব। ওর দেহে এই বিবর্তন আসার পর একবার বাঁচা-মরার ফয়সালা করে ছাড়ব।
আমিও বোধহয় এমনি স্বপ্ন দেখেছিলাম যে, মেমসাহেবকে পাবার পর সারা দুনিয়াটাকে একবার মজা দেখাব। আজ আমার পাশে মেমসাহেব থাকলে দুজনে মিলে হয়ত সত্যি অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করতাম। ভগবান নিজের মাতকবরী বজায় রাখবার জন্য আমাদের সে-সুযোগ দিলেন না। হিংসুটে ভগবান কেড়ে নিলেন। মেমসাহেবকে। হতচ্ছাড়া ভগবান যদি আমাদের মত রক্ত-মাংসের তৈরী হতেন, তাহলে অনুভব করতেন আমাদের জ্বালা-যন্ত্রণা। কিন্তু নিম্প্রাণ পাথরের ঐ মূর্তিগুলো কি করে অনুভব করবে। আমাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, জ্বালা-যন্ত্রণার কথা। মানুষের মনের কথা বুঝবে না বলেই তো ও পাথরের মূর্তি হয়ে আমাদের উপহাস করছে, বিদ্রেরূপ করছে।
কাজকর্ম, দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে একটু মুক্তি পেয়ে একটু একলা হলেই এইসব আজেবাজে চিন্তা করি। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, হয়ত মেমসাহেবকে নিয়ে অত আনন্দ করা আমার উচিত হয় নি। ভগবানের ব্যাঙ্কে আমার অদৃষ্ট যৌ-পরিমাণ আনন্দ জমা ছিল, আমি বোধহয় তার চাইতে অনেক, অনেক বেশি আনন্দের চেক কেটেছিলাম। তাই বোধহয় এখন সারাজীবন ধরে চোখের জলের ইনসটলমেণ্ট দিয়ে সে দেন শোধ করতে হবে। আবার কখনও কখনও মনে মনে সন্দেহ হয় যে, শ্যামবাজারের মোড়ে যেমন ফিরপো বা গ্র্যাণ্ড-গ্ৰেটইস্টার্ন হোটেল মানায় না, এসপ্ল্যানেডের মোড়ে যেমন ছানার দোকান বেমানান হয়, তেমনি আমার পাশেও বোধহয় মেমসাহেবকে মানাত না। আই এফ এস বা আই এ এস। বা টপ মাৰ্কেণ্টাইল একসিকিউটিভের পাশে ওকে যেমন মানাত, তেমনি কি আমার পাশে সম্ভব হতো? কিন্তু তাই যদি হয়, তাহলে ভগবান আমার জীবনে ওকে আনলেন কেন? কি প্ৰয়োজন ছিল এই রসিকতার?