মনে পড়ল। অনেকদিন আগে আমি যখন কলকাতায় রিপোর্টারী করতাম, তখন আমিও এমনি কত হিউম্যান স্টোরি লিখেছি, পড়েছি কিন্তু যেদিন আমার মেমসাহেবকে নিয়ে কলকাতার সব কাগজে এত বড় আর এত সুন্দর রিপোর্টটা ছাপা হলো, সেদিন অনেক চেষ্টা করেও আমি সে রিপোর্ট পড়তে পারলাম না।
বুকের মধ্যে খবরের কাগজগুলো চেপে জড়িয়ে ধরে শুধু নীরবে চোখের জল ফেলেছিলাম।
২০. তারপরের ইতিহাস
তারপরের ইতিহাস আর কি বলব? আমার জীবন-মধ্যাহোঁই এমন অপ্রত্যাশিতভাবে আমার জীবন-সূৰ্য চিরকালের জন্য ঘন কালে মেঘে ঢাকা পড়বে, কোনদিন কল্পনা করতে পারিনি। কিন্তু কি করব? ভগবান বোধহয় আমার জীবনটাকে নিয়ে লটারী খেলবার জন্যই আমাকে এই দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। জীবনে যা কোনদিন কল্পনা করিনি, যা আমার মত অতি সাধারণ ছেলের জীবনে হওয়া উচিত ছিল না, আমার জীবনে সেইসব অসম্ভবই সম্ভব হয়েছে। যা বহুজনের জীবনে সম্ভব হয়েছে ও হবে, যা আমার জীবনেও ঘটতে পারত, ঠিক তাই হলো না।
কেন, কেন আমার এমন হলো বলতে পার? কে চেয়েছিল জীবনে এই প্ৰতিষ্ঠা? অর্থ-যশ-প্ৰতিপত্তি? কে চেয়েছিল স্ট্যাণ্ডার্ড হেরান্ড? বছর বছর বিদেশ ভ্ৰমণ? আমি তো এসব কিছুই চাইনি। তিন-চারশ’ টাকা মাইনের সাধারণ রিপোর্টার হয়ে মীর্জাপুর বা বৈঠকখানাতেই তো আমি বেশ সুখে থাকতে পারতাম। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি অন্যান্য অনেকের মত আমিও তো পেতে পারতাম। আমার আশা-আকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন-সাধনার মানসীকে। আমার প্ৰেয়সীকে, আমার জীবন-দেবতাকে, আমার সেই এক অদ্বিতীয়া অনন্যাকে। ঐ পোড়ামুখী হতভাগী মেয়েটা আমার জীবনে এলে কি পৃথিবীর চলা থেমে যেত? চন্দ্ৰ-সূৰ্য ওঠা বন্ধ হতো?
মাঝে মাঝে মনে হয়, কালাপাহাড়ের মত ভগবানের সংসারে আগুন জ্বালিয়ে দিই। মনে হয় মন্দির-মসজিদ-গীর্জাগুলো ভেঙে চুরমার করে দিই। আমাদের মত অসহায় মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার ভগবানকে কে দিল? মায়ের কোল থেকে একমাত্র সন্তানকে কেড়ে নেবার অধিকার কে দিয়েছে ভগবানকে? লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষের পাকা ধানে মই দেবার সাহস ভগবানের এলো কোথা থেকে?
বিশে ফাল্গুন, ৬ই মার্চ বিয়ের দিন আমি মেমসাহেবের দেওয়া ধুতি-পাঞ্জাবি পরে গ্রীন পার্কের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ওর ঐ পোট্রেটটা কোলে নিয়ে এইসব আজে-বাজে কথা ভাবতে ভাবতে চোখের জল ফেলেছিলাম সারারাত। চোখের জল মুছতে মুছতে ঐ ফটোয় মালা পরিয়েছিলাম, সিন্দুর দিয়েছিলাম। আর? আদর করেছিলাম, বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে আদর করেছিলাম।
শুধু সেই শুভদিনে নয়, তারপর থেকে রোজই আমি গ্রীন পার্কে যাই। কাজকর্ম শেষ করে রোজ সন্ধ্যার পর ওখানে গিয়ে মেমসাহেবের সংসারের তদারকি করি, মেমসাহেবকে আদর করি, সুখ-দুঃখের কথা বলি। রোজ অন্তত একবার মেমসাহেবের কাছে না গিয়ে থাকতে পারি না। কোন কোনদিন কাজকর্ম শেষ করতে করতে অনেক রাত হয়, ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে চোখদু’টো ঘুমে ভরে আসে। মনে হয় ওয়েস্টার্ন কোটেই চলে যাই, শুয়ে পড়ি। কিন্তু কি আশ্চর্য! গাড়ির স্টিয়ারিংটা ঠিক হেষ্টিংস-তুগলক রোডের দিক ঘুরে সফদারজং এয়ারপোর্টের পাশ দিয়ে মেহেরালী রোড ধরে শেষপর্যন্ত গ্রীন পার্কে এসে হাজির হই।
লাদাক থেকে ফিরে এসে মেজদির কাছে যখন আমার চরম সর্বনাশের খবর শুনেছিলাম, তখন মনে হয়েছিল। আর বাঁচিব না। প্রিয়জনের বিয়োগ-ব্যথায় সব মানুষের মনেই এই প্ৰতিক্রিয়া হয়। আমারও হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমারও পরিবর্তন হয়েছে। মেমসাহেব নেই, কিন্তু আমি আছি। আমি মরিনি, মরতে পারিনি। আমি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতই বেঁচে আছি। আমাকে দেখে বাইরের কেউ জানতে পারবে না, বুঝতে পারবে না। যে আমার বুকের মধ্যে ব্যথা-বেদনা দুঃখ-আক্ষেপের হিমালয় লুকিয়ে আছে। আমার হাসি-ঠাট্টা হৈ-হুল্লোেড় দেখে কেউ অনুমান পৰ্যন্ত করতে পারেন না। এতবড় একটা বিয়োগান্ত নাটকের আমি হিরো। আমার মুখে হাসি আছে, কিন্তু মনের বিদ্যুৎ, প্ৰাণের উচ্ছ্বাস, চোখের স্বপ্ন চলে গেছে, চিরকালের জন্য, চিরদিনের জন্য চলে গেছে।
জান দোলাবৌদি, যতক্ষণ কাজকর্ম নিয়ে থাকি, ততক্ষণ বেশ থাকি। বুকের ভিতরের যন্ত্রণা ঠিক অনুভব করার অবকাশ পাই না। কিন্তু রাত্ৰিবেলা? যখন আমি সমস্ত দুনিয়ার মানুষের থেকে বহুদূরে চলে আসি, যখন আমি শুধু আমার স্মৃতির মুখোমুখি হই, তখন আর স্থির থাকতে পারি না। নিজেকে হারিয়ে ফেলি। সমস্ত শাসন অমান্য করে চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। মেমসাহেবের ফটোটাকে নিয়ে আদর করি, ভালবাসি, কথা বলি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলি। কত রাত হয়ে যায়, তবু ঘুম আসে না। আর ঘুম এলেও কি শান্তি আছে? ঐ হতচ্ছাড়ী পোড়ামুখী আমাকে একলা একলা ঘুমুতে দেখলে বোধহয় হিংসায় জ্বলোপুড়ে মরে। আমার ঘুম না ভাঙিয়ে ওর যেন শান্তি হয় না।
ফারাক গোরখপুরীর একটা শের মনে পড়ছে–
নিদ আয়ে, তো খোয়াব আয়ে
খোয়াব আয়ে, তো তুমি আয়ে
পর তুমহারি ইয়াদ মে
ন নিদ আয়ে, ন খোয়াব আয়ে।
চমৎকার। তাই না? ঘুম এলেই স্বপ্ন আসে, স্বপ্ন এলেই তুমি আস কিন্তু যেই তুমি আস তখন না আসে ঘুম, না আসে স্বপ্ন।
ফীরাক গোরখপুরীর জীবনেও বোধহয় আমারই মত কোন বিপৰ্যয় এসেছিল। তা না হলে এত করুণ, এত সত্য কথা, এত মিষ্টি করে লিখলেন কেমন করে? ফীরাক যা লিখেছেন তা বর্ণে বর্ণে সত্য। যেই চোখের পাতাদু’টো ভারী হয়ে বুজে আসে, সঙ্গে সঙ্গে ও পা টিপে টিপে আমার ঘরে ঢুকবে। আমি বুঝতে পেরেও পাশ ফিরে শুয়ে থাকি। ও আমার কাছে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়বে, কিন্তু তবুও আমি ওর দিকে ফিরে তাকাই না। হতচ্ছাড়ী আমাকে আদর করে ভালবেসে ঠোঁট দু’টোকে শেষ করে দেয়। তারপর কিছুক্ষণ আমার বুকের পর মাথা রেখে শোবে, হয়ত বা আমার মুখটাকে নিজের বুকের মধ্যে রেখে আমাকে জড়িয়ে শোবে। আর চুপ করে থাকতে পারে না। ডাক দেবে, শুনছ?