আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। বেশ কড়া করে দাবড় দিয়ে বললাম, কি হয়েছে মেমসাহেবের?
অস্পষ্ট স্বরে মেজদি জবাব দিলেন, সে আর নেই ভাই। মুহুর্তের মধ্যে মনে হলো সারা পৃথিবীটা অন্ধকারে ভরে গেল। কারা যেন অকল্যাণ হাতের ছোয়ায় পৃথিবী থেকে সবার প্রাণশক্তি হারিয়ে গেল। মনে হলো পায়ের নীচের মাটি সরে যাচ্ছে। আর আমি পাতালের অতল গহবরে ডুবে যাচ্ছি।
দোলাবৌদি, আমি আর দাঁড়াতে পারলাম না। পাড় মাতালের মত টলে পড়ে গেলাম সোফার পর। অত বড় একটা মহা সর্বনাশের খবর শোনার পর আমার কিছু হলো না। মহা আরামে ঘুমিয়ে পড়লাম। যখন ঘুম ভাঙল তখন দোখ রাত হয়ে গেছে আর আমার চারপাশে অনেকে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছেন। প্ৰথমে আমি কাউকে চিনতে পারছিলাম না। খানিকক্ষণ পরে চিনতে পারলাম। ডাঃ সেন আমার পাশে বসে আছেন।
আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ডাঃ সেন জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন আছেন?
ঘুম ভাঙার পর ডাঃ সেনকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। ভাবলাম বোধহয় বেড়াতে এসেছেন। তাই আমি পালটা প্রশ্ন করলাম, আপনি কেমন আছেন?
আমি ভাল আছি। আপনি ভাল তো?
বড্ড ঘুম পাচ্ছে। কাল আসবেন। আবার আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দিন অনেক বেলায় আমার ঘুম ভাঙিল। গজানন চা নিয়ে এলো, ফিরিয়ে দিলাম। স্নান করতে বললো, করলাম না। গজানন আবার কিছুক্ষণ পরে এসে অনুরোধ করল, আবার ওকে ফিরিয়ে দিলাম। আমি চুপচাপ বসে রইলাম।
এর পর মেজদি এসে অনুরোধ করলেন, নাও ভাই স্নান করে একটু কিছু মুখে দাও।
আমি কোন জবাবই দিলাম না। আরো কিছুক্ষণ এমনি করে বসে থাকার পর মনে হলো গ্ৰীনাপার্কে মেমসাহেবের সংসারটা দেখে আসি। গজাননকে ডাক দিয়ে বললাম, গাড়ি তৈয়ার করে।
কাঁহা, যানা ছোটোসাব? খুব মিহি গলায় গজানন জানতে চাইল।
গ্ৰীন পার্ক।
কিছুক্ষণ বাদে গজানন এসে খবর দিল, গাড়ি তৈয়ার হায় ছোটোসাব।
আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লাম। গজানন বললো, এই নোংরা জামাকাপড় পরে বেরুবেন? তবে কি সিল্কের পাঞ্জাবী চাপিয়ে বেরুব? একটা চটি পায় দিয়ে হন হন করে বেরিয়ে গেলাম। গজানন দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে পিছনের সীটে বসে পড়ল। মেজদিও নিঃশব্দে আমার পাশে এসে বসল।
সেদিন গাড়ি চালিয়েছিলাম বিদ্যুৎ বেগে। কোন স্টপ সিগন্যাল পর্যন্ত মানিনি। গজানন বললো, এতনা তেজ মাত চালাইয়ে। আমি ওর কথার কোন জবাবই দিলাম না। মেজদি বললেন, একটু আস্তে চালাও ভাই, বড় ভয় করে।
কিছু ভয় নেই মেজদি। আমরা মরব না।
সেদিন শ্ৰীনাপার্কের বাসায় গিয়ে প্ৰথমে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। চোখে জল এসেছিল। মুছে নিলাম। সমস্ত বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম, খুব ভাল করে দেখলাম। তারপর ড্রইংরুমে এসে বুক সেলফ-এর পর থেকে মেমসাহেবের পোট্রেটটা তুলে নিলাম।
ব্যস? আর আমি নিজেকে সংযত রাখতে পারিনি। হাউ হাউ করে, চীৎকার করে কাঁদতে লাগলাম। এত ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছিলাম যে চোখের জল ফেলতে পারিনি। পরবর্তীকালে জীবনে অনেক দুঃখ, অনেক আঘাত পেয়েছি কিন্তু তখনও চোখের জল ফেলার অবকাশ পাই নি। তাইতো সেদিন গ্ৰীনাপার্কের বাসায় আমার জমিয়ে রাখা সমস্ত চোখের জল বেরিয়ে এলো বিনা বাধায়।
মেমসাহেব আমার কাছে ছিল না, কিন্তু আমি স্থির জানি সে আমার কান্না না শুনে থাকতে পারে নি। আমার সমস্ত জীবনের চোখের জলের সব সঞ্চয় সেদিন ঐ পোড়ামুখীর জন্য ঢেলে দিয়েছিলাম, ভবিষ্যতের জন্য একটা ফোটাও লুকিয়ে রাখিনি।
মেজদি চুপটি করে পাশের সোফায় বসে কেঁদেছিলেন। গজানন দরজার ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেঁদেছিল।
চোখের জল থামলে মেজদিকে জিজ্ঞাসা করলাম, মেমসাহেবের কি হয়েছিল। মেজদি?
আর কি হবে? সেই কলকাতার চিরন্তন ঝামেলা আর খোকনের বিপ্লব।
পাঁচই ফেব্রুয়ারী। সওয়া-তিনটায় ক্লাস শেষ হবার পর মেমসাহেবের কলেজ থেকে বেরুতে বেরুতে প্ৰায় পৌনে চারটে হলো। হাওড়ায় এসে পাচ নম্বর বাস ধরল। বাড়ি যাবার জন্য। আগের কয়েকদিনের মত সেদিনও বাস ডালহৌসী হয়ে গেল না। যাই হোক বাসায় পৌঁছবার পরই খোকনের এক ক্লাস ফ্রেণ্ড বলাই হাঁপাতে হাঁপাতে এসে খবর দিল, ছোড়দি, খোকনের বুকে গুলী লেগেছে।
মেমসাহেব শুধু চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করেছিল, কোথায়?
এসপ্ল্যানেড ইস্ট এ। একমুহুর্ত নষ্ট করে নি মেমসাহেব। ট্যাক্সি নিয়ে ছুটেছিল এসপ্ল্যানেড। গ্র্যাণ্ড হোটেলের সামনে ট্যাক্সি থামল। পুলিস আর এগুতে দিল না। মেমসাহেব ঐখান থেকে দৌড়ে গিয়েছিল। এসপ্ল্যানেড ইস্টে। তখন সেখানে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ চলছে। মেমসাহেবও দৌড়ে দৌড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। খোকনকে পাবার জন্য। খোকনকে কি পাওয়া যায়? সে তো তখন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। মেমসাহেব খোকনকে না পেয়ে পাগল হয়ে উঠেছিল, কিন্তু বেশীক্ষণ তার পাগলামি করতে হয় নি। ঐ চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে, টিয়ারগ্যাসের ধোয়ার অন্ধকারের মধ্যে ছোট একটা রাইফেলের বুলেট এসে লেগেছিল বুকের মধ্যে।
আর খোকন? তার বুকে বুলেট লাগে নি, পায় লেগেছিল। ছোড়দিন মৃত্যু সংবাদে সেও উন্মাদ হয়ে উঠেছিল। মেডিক্যাল কলেজের সমস্ত রোগীর আর্তনাদ ছাপিয়ে খোকনের কান্না শোনা গিয়েছিল।
দুদিন পরে কলকাতার কাগজগুলো মেমসাহেবের মৃত্যু নিয়ে চমৎকার হিউম্যুন স্টোরি লিখেছিল। একটা কাগজে মেমসাহেব, আর খোকনের ছবি পাশাপাশি ছেপেছিল। রিপোর্টটা পড়ে সবার মন খারাপ হয়েছিল। স্কুল-কলেজ, অফিসে, রেস্তোরাঁয়, ট্রামেবাসে, লোক্যাল ট্রেনে সবাই এই স্টোরিটা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। পুলিসের লোক’জনও পড়েছিল। সবাই দুঃখিত, মৰ্মাহত হয়েছিলেন।