বিয়ের আগে আর কলকাতা আসা হবে না ভেবে বিয়ের কিছু কাজও করলাম। কলকাতায়। দিল্লীতে ভাল পাঞ্জাবী তৈরী হয় না; ভবানীপুরের একটা দোকান থেকে তিন গজ ভাল সিল্কের কাপড় কিনে শ্যামবাজারে মণ্টুবাবুর দোকানেপাঞ্জাবী তৈরী করতে দিলাম। দিল্লীতে ভাল বাংলা কার্ড পাওয়া যায় না; সুতরাং কয়েকশ কার্ড কিনলাম। আর? আর কিনেছিলাম সিন্ধ হাউস দোকান থেকে মেমসাহেবের জন্য দু’টো বেনারসী শাড়ি। দিল্লীতে বেনারসী পাওয়া যায় কিন্তু বড্ড বেশী দাম। তাছাড়া ঠিক রুচিসম্মত পাওয়া প্ৰায় অসম্ভব। শাড়ি দু’টো কেনার সময় মেমসাহেবকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম পছন্দ করবার জন্য। স্কাই কলারের বেনারসীটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল, ওরও খুব ভাল লেগেছিল। কিন্তু বার বার বলেছিল, কেন এত দামী শাড়ি কিনছ?
আমি বলেছিলাম, এর চাইতে কম দামের শাড়িতে তোমাকে মানাবে না।
ও ভ্রূ কুঁচকে একটু হাসতে হাসতে বলেছিল, তাই নাকি?
তবে কি?
শাড়ি কিনে দোকান থেকে বেরুবার সময় মেমসাহেব বললো, তুমি আমার দেওয়া ধুতি-পাঞ্জাবী পরে বিয়ে করতে আসবে।
সেকি? আমি তো কাপড় কিনে পাঞ্জাবী তৈরী করতে দিয়ে দিয়েছি।
তা হোক। তুমি আমার দেওয়া ধুতি-পাঞ্জাবী পরে বিয়ে করবে।
সেন্টাল এভিন্যুর খাদি গ্রামোদ্যোগ থেকে মেমসাহেব আমার পাঞ্জাবীর কাপড় কিনে বললো, চল এবার ধুতিটা কিনতে যাই।
ধুতি কিনতে গিয়ে আমি ওর কানে কানে ফিসফিস করে বললাম, প্লেন পাড় দেবে, না, জরি পাড় দেবে?
আগে কতবার জরি পাড় ধুতি চেয়েছি পাই নি। এবার পেলাম। একটা নয়, একজোড়া।
আমি জানতে চাইলাম, একজোড়া ধুতি পরে বিয়ে করতে যাব?
অসভ্যতা করে না। একটু থেমে বললো, তোমার তো মোটে দু’টো ধুতি। তাই একজোড়াই থাক।
ধুতি কিনে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি তো আমার বিয়ের কাপড় দিলে, ফুলশয্যার জন্য তো কিছু দিলে না?
ও আমার কথার জবাব না দিয়ে বললো, সেদিন যে তুমি কি করবে, তা ভাবতেই আমার গায় জ্বর আসছে।
তাই নাকি? একটু থেমে আবার বললাম, বেশ, তাহলে শুধু বিয়েই হোক, ফুলশয্যার আর দরকার নেই।
ও একটু বাঁকা চোখে হাসি হাসি মুখে বললো, ভূতের মুখে রাম नांभ?
কলকাতায় এমনি করে। কটা দিন বেশ কেটে গেল। আমার কলকাতা বাসের মেয়াদ শেষ হলো। দেহটাকে আবার চাপিয়ে দিলাম দিল্লী মেলের কামরায়। মন? সে পড়ে রইল। কলকাতায়। মেমসাহেবের কাছে।
দিল্লীতে ফিরে এসে আবার বেশ কাজকর্মের চাপ পড়ল। দশ-বারে দিন প্ৰায় নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ পেলাম না। সমাগত কংগ্রেস অধিবেশনের জন্য কংগ্রেস পাটিতে দলাদলি চরম পর্যায়ে পৌঁছল। কংগ্রেসের ঘরোয় বিবাদ যত তীব্র থেকে তীব্রতর হলো, আমাদের কাজের চাপও তত বেশী বাড়ল।
এদিকে কলকাতার কাগজ পড়ে বেশ বুঝতে পারছিলাম অবস্থা সুবিধার নয়। গণ্ডগোল শুরু হলো বলে।
মাদ্রাজে কংগ্রেস অধিবেশন কভার করতে গিয়েই খবর পেলাম, কলকাতায় গুলী চলেছে। দুজন মারা গেছে। বাংলাদেশে, বিশেষ করে কলকাতা শহরে এই ধরনের রাজনৈতিক নাটক প্রায়ই অভিনীত হয়।
দিল্লী ফিরে এসে খবর পেলাম ডুয়ার্সে, কৃষ্ণনগরে, দুর্গাপুরে, আর বসিরহাটেও গুলী চলেছে। কিছু আহত কিছু নিহত হয়েছে। বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লাম। না জানি খোকন আবার কি করে। গতবার কলকাতায় গিয়ে তো কত বুঝিয়ে এলাম। কিন্তু সন্দেহ হলো ওসব কিছুই হয়ত ওর কানে ঢোকে নি। উপদেশ আর পরামর্শ দিয়ে যদি কাজ হতো তাহলে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে বিদ্যাসাগরবিবেকানন্দ-নেতাজীকে পাওয়া যেত।
ইতিমধ্যে ভারতবর্ষের শান্ত হিমালয় সীমান্ত আরো অশান্ত হয়ে উঠেছিল। সীমান্ত নিয়ে অনেক আজগুবী কাহিনী ছাপা হচ্ছিল নানা পত্র-পত্রিকায়। স্বাভাবিক ভাবেই সরকার উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন এসব খবরে। তাছাড়া পার্লামেন্টের বাজেট অধিবেশন এসে গিয়েছিল। . এই সময় এই ধরনের খবর নিয়মিত ছাপা হলে পার্লামেণ্টে অযথা ঝড় বয়ে যাবে। অনেক ভাবনা-চিন্তার পর সরকার একদল জার্নালিস্টকে লাডাকে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমি হেড কোয়ার্টার্সের ঠিক মত ছিল না; কারণ, এই তীব্র ঠাণ্ডায় জার্নালিস্টদের লাডাকে নিতে হলে অনেক ঝঞ্চাট। কিন্তু শেষপৰ্যন্ত তাঁরাও রাজী হলেন। দশজন দেশী-বিদেশী সাংবাদিক দলে আমিও স্থান পেলাম।
এক সপ্তাহের প্রোগ্রাম। মেমসাহেবকে জানালাম, এক সপ্তাহের জন্য লাডাক যাচ্ছি। আমরা হওনা হবে ২রা ফেব্রুয়ারী। এখান থেকে জম্মু যাব। সেখান থেকে উধমপুর, কোর কমাণ্ডারের হেড কোয়ার্টার্স। একদিন উধমপুর থেকে যাব লোতে। সেখানে একদিন থেকে যাব অপারেশন্যাল এরিয়া তিজিট করতে। ফিরে এসে আবার একদিন লোতে থেকে ফিরব দিল্লী।
১৪ই ফেব্রুয়ারী বাজেট অধিবেশন শুরু হবে। ২৮শে ফেব্রুয়ারী বাজেট পেশ করা হবে। আমি ৪ঠা মার্চ কলকাতা রওনা হবো। বাবা বেনারস থেকে ২রা কি ৩রা কলকাতা পৌঁছবেন। ৬ই মার্চ বিয়ে হবার পর ৮ই মার্চ ডি-লুকস একসপ্রেসে তোমাকে নিয়ে আবার দিল্লী ফিরব। ১৪ই মার্চ আমার ছুটি শেষ হবে। সুতরাং যদি কোথাও বাইরে বেড়াতে যেতে চাও, তাহলে ঐ কদিনের মধ্যেই ঘুরে আসতে হবে। পার্লামেণ্ট শেষ হলে তোমাকে নিয়ে নিশ্চয়ই কোথাও বেড়াতে যাব। কেমন? মত আছে তো?
মেমসাহেব লিখল, তোমার চিঠিতে জানলাম, তুমি লাডাক যাচ্ছি। তুমি যখন সাংবাদিক, তখন তোমাকে তো সর্বত্রই যেতে হবে। অনেক সময় বিপদের মুখোমুখি হতে হবে তোমাকে। আমার মুখ চেয়ে নিশ্চয়ই তুমি সব সময় সাবধানে থাকবে। তবে আমি জানি, তোমাকে কোন বিপদ স্পৰ্শ করতে পারবে না।