রাত্রে নেমন্তান্ন খেতে গিয়েছিলাম। মেমসাহেবের দেওয়া ধুতি পাঞ্জাবী পরে সত্যি প্ৰায় জামাই সেজে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলাম। মেমসাহেব আমারই অপেক্ষায় বসেছিল ড্রইংরুমে। কিন্তু যেই আমি বাজার বাজালাম, ও সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বললো, মেজদি। দেখত, কে এসেছে। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ওর কথা শুনতে পেলাম। এমন একটা ভাব দেখােল যেন ওর কোন গরজ নেই। আসল কথা লজ্জা করছিল।
মেজদি দরজা খুলেই চিৎকার করলেন, মা! তোমার ছোট জামাই এসেছেন।
ভিতর থেকে মেমসাহেবের মার গলা শুনতে পেলাম, আঃ চিৎকার কারিস না।
মেজদি ঘর ছেড়ে ভিতরে যাবার সময় হুকুম করে গেলেন, চুপটি করে বসুন। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলার প্রয়োজন নেই, এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
মেজদির বিদায়ের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মেমসাহেব এলো। একটু এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। আমি ওর হাত ধরে পাশ থেকে সামনে নিয়ে এলাম। তারপর দু’হাত দিয়ে ওর কোমরটা জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে আলতো করে মাথাটা রাখলাম।
ও আমায় মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, আঃ ছেড়ে দাও। কেউ এসে পড়বে।
আমি ওর কথার কোন জবাব দিলাম না। আমনি করেই ওকে জড়িয়ে ধরে রইলাম।
ও আস্তে আস্তে আমার হাতদু’টো ছাড়িয়ে দিতে দিতে বললো, লক্ষ্মীটি ছেড়ে দাও, কেউ দেখে ফেলবে।
আমি এবার ওর হাতদু’টো ধরে মুখের দিকে চাইলাম। বললাম দেখুক না। কি হয়েছে?
ও একটা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আমার মুখে, কপালে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, কেমন আছ?
ভাল।
একটু থেমে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কেমন আছ?
ভাল না।
কেন।
কেন আবার? আমার আর একলা একলা থাকতে একটুও ভাল লাগছে না।
আমি ওর ফোলা ফোলা গালদু’টো একটু টিপে ধরে বললাম, এইত এসে গেছে। আর তো দুমাসও বাকি নেই।
সেদিন রাত্রে মেমসাহেবের মা সত্যি জামাই-আদর করে খাওয়ালেন। ছোটবেলায় মাকে হারিয়ে অত আদর-যত্ন পাওয়া কোনদিন অত্যাস নেই। অত ভালমন্দ খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাসও কোনদিন ছিল না। আমি কোনটা খেলাম, কোনটা খেলাম না।
খাওয়া-দাওয়ার শেষে ডুইংরুমে বসে বসে মেজদি আর মেমসাহেবের সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করলাম। শেষে মেমসাহেবের মাকে প্ৰণাম করে বিদায় নেবার সময় উনি আমার হাতে একটা পাথর সেটকরা আংটি পরিয়ে দিলেন। আমি বললাম, একি করছেন?
বিয়ের আগে তো আর তুমি আসছ না। আশীৰ্বাদ তো বিয়ের আসরেই হবে। তাই এটা থাক।
আমি আবার আপত্তি করলাম। উনি বললেন, মায়ের আশীৰ্বাদ না করতে নেই।
আমি আপত্তি করলাম না।
পরের দিন মেমসাহেব আর আমি দক্ষিণেশ্বর গিয়েছিলাম। সন্ধ্যার পর আরতি দেখে নৌকায় চড়ে গিয়েছিলাম বেলুড়। পৌষ মাসের সন্ধ্যায় মিষ্টি ঠাণ্ডা হাওয়া বইছিল গঙ্গার পর দিয়ে। মেমসাহেব আমার পাশ-ঘেষে বসে আমার কাঁধে মাথা রাখল।
সেদিন সন্ধ্যায় বিশেষ কথাবার্তা হয় নি আমাদের। আনন্দতৃপ্তিতে দুজনেরই মনটা পূর্ণ হয়েছিল। বেশী কথাবার্তা বলতে কারুরই মন চায় নি।
মেমসাহেব জিজ্ঞাসা করেছিল, তুমি আর এর মধ্যে কলকাতা আসবে না?
না।
একেবারে সেই বিয়ের সময়?
হ্যাঁ।
একটু পরে আবার বলেছিল, বিয়ের পর তুমি কিন্তু আমাকে তোমার মনের মতন করে গড়ে নিও। আমি যেন তোমার সব প্ৰয়োজন মেটাতে পারি।
আমার সব প্রয়োজনের কথাই তো তুমি জান। তাছাড়া তুমিই তো আমাকে গড়ে তুলেছি। সুতরাং আমি আর তোমাকে কি গড়ে তুলিব?
আমি তো নিমিত্ত মাত্ৰ। তোমার নিজের মধ্যে গুণ ছিল বলেই তুমি জীবনে দাঁড়াতে পেরেছ। গুণ না থাকলে কি কেউ কাউকে কিছু করতে পারে?
আমি বললাম, পারে বৈকি মেমসাহেব। শুধু ইট-কাঠ-সিমেন্ট হলেই তো একটা সুন্দর বাড়ি হয় না। আর্কিটেকট চাই, ইঞ্জিনীয়ার চাই, মিস্ত্রী চাই। সোনার তালের দাম থাকতে পারে। কিন্তু তার সৌন্দৰ্য নেই। স্বর্ণকারের হাতে সেই সোনা পড়লে কত সুন্দর সুন্দর গহনা হয়।
ওর মুখের পর মুখ রেখে বললাম, মেমসাহেব, তুমি আমার সেই আর্কিটেকট, ইঞ্জিনীয়ার, শিল্পী।
ও আমার এসব কথার জবাব না দিয়ে বললো, তুমি আমাকে বড্ড বেশী ভালবাস। তাইতো তুমি আমাকে অকৃপণভাবে মৰ্যাদা দিতে চাও। মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে বললো, তাই না?
তোমার মত আমি তো ইউনিভার্সিটিতে পড়িনি। মনুষ্যচরিত্রের অতশত বিশ্লেষণ করতে আমি শিখিনি।
মেমসাহেব এবার যেন একটু অভিমান করে বললো, ওসব আজেবাজে কথা বলবে না তো! হাজার হোক তুমি আমার স্বামী। আর তাছাড়া এম-এ পড়লেই কি সবাই পণ্ডিত হয়ে যায়? ও নিজেই নিজের প্রশ্নের জবাব দিল, মোটেই না। তোমার জ্ঞান, বুদ্ধি, অভিজ্ঞতার কাছে আমি কি দাঁড়াতে পারি?
দোলাবৌদি, মেমসাহেব শুধু আমাকে ভালবাসত না, শ্রদ্ধা করত, ভক্তি করত। সোনায় যেমন একটু পান মিশিয়ে না নিলে গহনা মজবুত হয় না, সেইরকম ভালবাসার সঙ্গে একটু শ্ৰদ্ধা, ভক্তি না মিশলে সে ভালবাসাও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। মেমসাহেব আজ অনেক-অনেক দূরে চলে গেছে। কিন্তু যত দূরেই যাক, যেখানেই থাকুক, আমি নিশ্চিত জানি সে আজও আমাকে ভুলতে পারে নি। আমি জানি, সে আজও আমাকে ভালবাসে। প্রতিটি দিনের প্রতিটি মুহুর্তের স্মৃতি আজও তার মনে আছে।
কলকাতায় আরো কদিন ছিলাম। এবার সবাইকে বলে দিলাম, আসছে ফাঙ্কনে মেমসাহেবের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে। কেউ অবাক হলো, কেউ কেউ আবার বললো, আমরা আগেই জানতাম। আমি কারুর কোন মন্তব্য গ্ৰাহ্য করলাম না। গ্ৰাহ করব। কেন? তোমরা কি কেউ আমাকে ভালবেসেছ? কেউ কি আমার বিপদের দিনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছ? কেউ তো একটা পয়সা দিয়ে বা এক কাপ চা খাইয়ে উপকার কর নি। সুতরাং তোমাদের আমি থোড়াই কেয়ার করি। যখন যেখানে যার সঙ্গে দেখা হয়েছে তাকেই বলেছি, আমার বিয়ে। মেমসাহেবের সঙ্গে। কবে? এইত এই ফাল্গুনেই। বহুজনকে নেমস্তন্নও করেছিলাম, আসতে হবে কিন্তু। বন্ধুবান্ধবদের বললাম, এবার যদি তোরা দিল্লী না আসিস তবে ফাটাফাটি হয়ে যাবে।