আচ্ছা সেদিন তুমি হঠাৎ ট্রাঙ্ককল করলে কেন বলত? কলেজের অফিসে তখন লোকজনে ভর্তি ছিল। প্ৰথমে প্রিন্সিপ্যালই টেলিফোন ধরেন। তারপর যেই শুনলেন দিল্লী থেকে আমার ট্রাঙ্ককল এসেছে তখন তার আর বুঝতে বাকি রইল না যে তুমিই ট্রাঙ্ককাল করছি। কারণ তোমার সঙ্গে যে আমার বিয়ে হবে, একথা কলেজের সবাই জানেন। প্রিন্সিপ্যালও শুনেছেন। তাছাড়া বেরুটি থেকে কেনা জার্মান ফোলডিং ছাতাটা দু-একদিন ব্যবহার করায় উনি একথাও জানতে পেরেছেন যে তুমিই এনে দিয়েছ। তাই তো প্রিন্সিপ্যাল লাইনটা অফিসে দিয়েছিলেন এই ভেবে যে, আমি ওঁর সামনে তোমার সঙ্গে ঠিকমত কথা বলতে পারব না। কিন্তু কলেজের অফিস কি ফাঁকা থাকে? আমি তোমার কোন কথারই জবাব দিতে পারছিলাম না। তাছাড়া ওসব কি যা তা প্রশ্ন করছিলে? কলেজের অফিসে বসে বসে ঐসব প্রশ্নের জবাব দেওয়া যায়? তাছাড়া আমার এই সব একান্ত ব্যক্তিগত ও গোপনীয় খবর জানার যদি এতই গরজ হয়, তাহলে একবার চলে এসে। আসবে দু-এক দিনের জন্য? এলে খুব খুশি হব।
বিয়ের সময় তুমি আমাকে কিছু উপহার দিতে চেয়েছ। শাড়িগহনার কথা বলছ? ওসব কিছু আমার চাই না। আজ আমার শুধু একটাই কামনা–সে কামনা তোমাকে পাওয়ার। মন-প্ৰাণ দিয়ে তোমাকে আমি পেতে চাই। তাহলেই আমি খুশি। স্ত্রী হয়ে আর কি কামনা, আর কি প্ৰত্যাশা থাকতে পারে? সত্যি বলছি তুমি আমাকে কিছু উপহার দিও না। আমি শুধু তোমাকেই উপহার চাই। দেবে তো?
মেজদি থাকতে ওকে ম্যানেজ করে নানা রকম ধোকা দিয়ে তোমার কাছে গেছি কবার। এখন আর তা সম্ভব নয়। তাই বলছিলাম তুমি যদি আসতে। তবে ভাল হত। তোমাকে না দেখে আমি থাকতে পারি না। তুমি কি আমার সে কষ্ট উপলব্ধি করতে পার? যদি পাের। তবে দয়া করে অন্তত একটি দিনের জন্য দেখা দিয়ে যেও।
ভাল কথা, মেজদির বাচ্চা হবে। এইত কমাস আগে বিয়ে হলো! এরই মধ্যেই বাচ্চা? না জানি আমার অদৃষ্ট কি আছে?
মেমসাহেবের এই চিঠির উত্তর তো পোস্টকার্ডে দেওয়া যায় না। কর্মব্যস্ততার জন্য তাই কদিন চিঠি দিতে পারিনি। তাছাড়া কদিনের জন্য সৌরাষ্ট্র গিয়েছিলাম। এমনি করে উত্তর দিতে বেশ দেরী হয়ে গেল। ইতিমধ্যে মেমসাহেবের আবার একটা চিঠি পেলাম। জানলাম, ইতিমধ্যে একদিন ভোর পাঁচটার সময় পুলিস এসে খোকনদের ফ্ল্যাট সার্চ করে গেছে। খোকনকেও ধরে নিয়ে গিয়েছিল। বিকেলবেলা ছেড়ে দিয়েছিল।
কলকাতার কাগজগুলো পড়ে বেশ বুঝতে পারছিলাম। বাংলা দেশের রাজনৈতিক আকাশের ঈশান কোণে ঘন কালো মেঘা জমতে শুরু করেছে। দামামা আবার বেজে উঠবে। সভা-সমিতির পালা এবার শেষ হবে, শুরু হবে মিছিল, বিক্ষোভ, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ। তারপর লাঠি, কাঁদুনে গ্যাস, গুলী। আবার বিক্ষোত, আবার মিছিল হবে। আবার চলবে লাঠি, গুলী। কিছু মানুষ হারাবে তাদের প্ৰিয়জনকে। তার কাঁদবে, সারা জীবন ধরে কাঁদবে।
খোকন যে বেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে, সেকথা বুঝতে আমার কষ্ট হল না। এ নেশার ঘোর ওর এখন কাটবে না। কিছু খেসারৎ না দিলে এ নেশা। কাটে না। অনেকের কোন কালেই কাটে না। খোকনেরও কাটবে। কিনা ঠিক নেই।
মেমসাহেব অবশ্য ভাবছিল আমি কলকাতা গিয়ে খোকনকে বুঝিয়ে-সুবিয়ে একটা কিছু করি। কিন্তু কি করব? কি বোঝাব ‘ খোকনকে? বোঝাতে চাইলেই কি সে বুঝবে? আমারও মেমসাহেবকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছিল। ভেবেছিলাম দু-তিন দিনের জন্য ঘুরে আসব। কিন্তু মেমসাহেবের পরের চিঠিতে খোকনের খবর পাবার পর ঠিক করলাম, না যাব না। মেমসাহেবকে লিখে দিলাম, সত্যি ভাষণ ব্যস্ত। এখন কোনমতেই যেতে পারছি না। যদি এর মধ্যে সময় পাই তাহলে নিশ্চয়ই তোমাকে দেখে আসব। শেষে লিখলাম রাজনীতি অনেকেই করে, খোকনও করছে। তার জন্য অত চিন্তা বা ঘাবড়াবার কি কারণ আছে? তাছাড়া খোকন তো আর শিশু নয়। সুতরাং তুমি অত ভাববে না।
খোকন সম্পর্কে আমার এই ধরনের মন্তব্য মেমসাহেব ঠিক পছন্দ করত না, তা আমি জানতাম। কিন্তু কি করব? আমি স্থির জানতাম খোকন আমার কথা শুনবে না। মেমসাহেবের কথাও তার পক্ষে শোনা তখন সম্ভব ছিল না। সুতরাং আমি আর কি লিখব?
আমার চিঠি পাবার সঙ্গে সঙ্গেই মেমসাহেব উত্তর দিল, যে কোন কারণেই হোক তুমি খোকন সম্পর্কে বেশ উদাসীন। হয়ত ওকে ঠিক পছন্দ করো না। জানি না কি ব্যাপার। তোমার সঙ্গে এ বিষয়ে তর্ক করব না। তবে জেনে রাখা খোকন সম্পর্কে আমার ও আমাদের পরিবারের ভীষণ দুর্বলতা।
আমি সত্যি কোন তর্ক করিনি। তর্ক করব কেন? মানুষের স্নেহ-ভালবাসা নিয়ে কি তর্ক করা উচিত? কখনই নয়। তাছাড়া যুক্তি-তর্ক ন্যায়-অন্যায় বাচ-বিচার করে কি মানুষ তালবাসতে পারে? না। তা আমি জানি। সুতরাং এই বিষয়ে মেমসাহেবকে কিছু না লিখে এবার খোকনকেই একটা চিঠি দিলাম। লিখলাম, তোমার মত ভাগ্যবান ছেলে এই পৃথিবীতে খুব কম পাওয়া যাবে। তার কারণ এই পৃথিবীটা বড় নিষ্ঠুর, বড় কৃপণ। আপনজনের কাছ থেকেই ভালবাসা পাওয়া এই পৃথিবীতে একটা দুর্লভ ব্যাপার। সুতরাং অন্যের কাছ থেকে স্নেহভালবাসা সত্যি সৌভাগ্যের কথা। তুমি সেই অনন্য ভাগ্যশালীদের অন্যতম। অনেক সুখ, অনেক আনন্দ ত্যাগ করে, অনেক কষ্ট, অনেক দুঃখ সহ্য করে, অনেক আত্মত্যাগ স্বীকার করে তোমার বড়মা ও দিদিরা তোমাকে মানুষ। করেছেন। তোমাকে নিয়ে ওঁদের অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন। তোমার গায় একটু আঁচড় লাগলে ওদের পাজরার একটা হাড় ভেঙে যায়। হয়ত এতটা স্নেহ-ভালবাসার কোন অর্থ হয় না। কিন্তু তুমি তো জান ভাই এই স্নেহ-ভালবাসা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। তোমার বড়মা ও দিদিদেরও তাই অন্ধ করে দিয়েছে। তুমি ওদের এই অমূল্য স্নেহ-ভালবাসার অমর্যাদা কোনদিন করবে না, তা আমি জানি। কিন্তু তোমার জন্য আজকাল ওঁরা বড় চিন্তিত, বড় উদ্বিগ্ন। তুমি কি এর থেকে ওঁদের মুক্তি দিতে পার না? আমার মনে হয় তুমি ইচ্ছা করলেই পার। যাঁরা তোমার জন্য দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর রাত্রি জেগে কাটিয়েছেন, যাঁরা তোমার কল্যাণে ব্ৰত-উপবাস করেছেন, কালীঘাটে পূজা দিয়েছেন, তারকেশ্বরে ছুটে গিয়েছেন, তুমি কি তাদের উৎকণ্ঠ দূর করতে পার না? পার না। ওঁদের চোখের জল বন্ধ করতে? একটু স্থির হয়ে ভেবে দেখা।