অদৃষ্ট নেহাতই তাল। বেশিদূর এগুতে হলো না। হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। আজ আত্মজীবনীর সেই রঙীন দিনগুলোর কথা মনে হলে হাসি পায়। সেদিন। কিন্তু হাসি পায় নি। মরীচিকাকেই সেদিন জীবনের চরম সত্য বলে মনে করে। ছুটেছিলাম। ঘটনাটা নেহাতই সামান্য।
বারাকপুর-টিটাগড় বা খিদিরপুরের বড় বড় কলকারখানার মত তখন আমাদের কলেজও তিন শিফটএ হতো। সকালে মেয়েদের, দুপুরে ছেলেদের, রাত্ৰিতে প্ৰৌঢ়দের ক্লাশ হতো। বেথুন বা লেভী ব্ৰাবোর্মের ছাত্রীদের মধ্যে যুবতী কুমারীদের মেজরিটি থাকলেও আমাদের কলেজের মর্নিং সেকসনের চেহারা ছিল আলাদা। নীলিমা সরকারের মত সদ্য প্ৰস্ফুটিত গোলাপের সংখ্যা খুব বেশী ছিল না। দেশটা স্বাধীন হবার পর অনেকের সংসারেই আগুন লাগল। এক টুকরো বস্ত্ৰ আর এক মুষ্টি অন্নের জন্য, রুগ্ন শিশুর একটু পথ্যের জন্য, জীবনধারণের নিতান্ত প্ৰয়োজনীয় দাবী মেটাবার জন্য বাংলা দেশের হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ গৃহস্থ বধুদের ডালহৌসী স্কোয়ারের রঙ্গমঞ্চে নামতে হলো। তাইতো এই ডালহৌসী রঙ্গমঞ্চে আসবার পাশপোর্ট যোগাড় করার জন্য অনেক বৌদি আর ছোট মাসিমারাই আবার কলেজে পড়া শুরু করলেন। তাছাড়া আর একদল মেয়েরা নতুন করে উচ্চ শিক্ষা নিতে সে সময় শুরু করলেন। দেশটা স্বাধীন হবার পর অনেক অন্ধকার ঘরেই হঠাৎ বিংশ শতাব্দীর আলো ছড়িয়ে পড়ল। আমাদের কলেজের বীণামাসির মত যারা কোন অন্যায় না করেও স্বামী ও শ্বশুর-বাড়ির অকথ্য অত্যাচার দিনের পর দিন, বছরের পর বছর সহ করেছেন, যারা বিবাহিতা হয়েও স্ত্রীর মর্যাদা পাননি, স্বামীর ভালবাসা পাননি, সন্তানের জননী হয়েও যাঁরা মা হবার গৌরব থেকে বঞ্চিতা হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই বন্দীশালার অন্ধকূপ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলেন। অজানা, অজ্ঞাত, ভবিষ্যতের সঙ্গে মোকাবিলা করবার জন্য এদের অনেকেই আবার কলেজে ভর্তি হলেন। আমাদের কলেজেও অনেকে ভৰ্তি হয়েছিলেন।
দিনের বেলায় হাফ আদর্শবাদী, হাফ ভাবুক, হাফ পলিটাসিয়ান, হাফ অভিনেতা, হাফ গায়ক, হাফ খেলোয়াড়দেরই সংখ্যা ছিল বেশী। সন্ধ্যার পর যারা আসতেন। তাঁদের অধিকাংশই ডালহৌসী-ক্যানিং স্ট্রট-ক্লাইভ স্ট্রট থেকে অধমৃত অবস্থায় ছুটতে ছুটিতে কলেজে আসতেন।
সওয়া দশটায় মেয়েদের ক্লাশ শেষ হতো আর ছেলেদের ক্লাশ শুরু হতো। আমার ক্লাশ কোনদিন সওয়া দশটায়, কোনদিন এগারটায় শুরু হতো। সওয়া দশটায় ক্লাশ থাকলে ছেলেরা কোনদিন লেট করত না। বরং দশটা বাজতে বাজতেই কমনরুম ছেড়ে দোতলা-তিনতলার দিকে পা বাড়াত। সওয়া দশটার সন্ধিলয়ের প্রতি অন্যান্য ছাত্রদের মত আমারও আকর্ষণ ছিল। কিন্তু সকালবেলায় দুদু’টো টিউশানি করে কলেজে আসতে আসতে প্ৰায় সাড়ে দশটা হয়ে যেত। তাইতো সওয়া দশটার ক্ষণিক বসন্তের হাওয়া আমার উপভোগ করার সুযোগ নিয়মিত হতো না।
বীণামাসির সঙ্গে প্রায়ই পূরবী সিনেমার কাছাকাছি দেখা হতো। বীণামাসি বিবাহিত যুবতী। কিন্তু সিঁদুর পরত না। বীণামাসি বলত, বিয়ে করেও যখন স্বামীকে পেলাম না, শ্বশুরবাড়িতেও স্থান পেলাম না, তখন সিন্দুর পরব। কার জন্য? কিসের জন্য? ফুটপাথের এক পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমরা দু’চার মিনিট কথাবার্তা বলতাম। কলেজের ছোকরা অধ্যাপক ও ছাত্রদের কেউ কেউ পাশ দিয়ে যাবার সময় একটু সরস দৃষ্টি দিয়ে চাইতেন। বীণামাসি ও আমি দুজনেই তা লক্ষ্য করতাম। কিন্তু গ্ৰাহ করতাম না।
পর পর ক’দিন বীণামাসির সঙ্গে দেখা হলো না। প্ৰথম ক’দিন বিশেষ কিছু ভাবিনি। পুরো একটা সপ্তাহ দেখা না হবার পর একটু চিন্তিত না হয়ে পারলাম না। অথচ বীণামাসিদের বাড়ি গিয়ে খোজ করব সে সময়ও হয় না। কলেজ শেষ হতে না হতেই আবার টিউশানি করতে ছুটতে হয়।
সেদিনও কলেজে আসবার পথে বীণামসির দেখা পেলাম না। কিন্তু ঐ পূরবী সিনেমার কাছাকাছিই হঠাৎ একটা জীবন্ত বারুদের ভূপ আমার সামনে থমকে দাঁড়াল। বললো, শুনুন। বীণাদির খুব অসুখ। আপনাকে যেতে বলেছেন।
সকাল সাড়ে দশটার সময় হ্যারিসন রোডের পর পূরবী সিনেমার পাশে এমনভাবে এক’জন সুন্দরী আমাকে বীণামাসির সমন জারী করবে, কল্পনাও করতে পারিনি। মুহুর্তের জন্য ভড়কে চমকে গিয়েছিলাম। একটু সামলে নেবার পর অনেক প্রশ্ন মনে এসেছিল। কিন্তু গলা দিয়ে সেসব প্রশ্ন বেরুতে সাহস পায় নি। শুধু বলেছিলাম, আপনি জানলেন কি করে?
–আমি বীণাদির বাড়ি গিয়েছিলাম।
সেই দিনই বিকেলবেলা বীণামাসিকে দেখতে গিয়েছিলাম। আমি যেতেই বীণামাসি আমাকে প্রশ্ন করল, নীলিমার কাছে খবর পেয়েছিস বুঝি?
আমি বললাম, কোন নীলিমা?
ঐ যে আমাদের সঙ্গে পড়ে নীলিমা সরকার…
তা জানিনে, তবে আজ সকালেই পূরবীর কাছে একটা সুন্দর ধরনের মেয়ে…
বীণামাসি আর এগুতে দিল না। বললে, হ্যাঁ, হ্যাঁ ঐ তো নীলিমা।
আমি বললাম, তাই বুঝি?
বীণামাসির কাছে আমি আমার চিত্তচাঞ্চল্যের বিন্দুমাত্ৰ আভাস দিলাম না। নিজেকে সংযত করে নিলাম। কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে সেদিনের মত বিদায় নেবার আগে বীণামাসিকে জিজ্ঞাসা করলাম, কলেজ থেকে কেউ তোমাকে দেখতে আসেন না।
হ্যাঁ, অনেকেই আসে।
তিন-চারদিন পরে আবার বীণামাসিকে দেখতে গেলাম। গিয়ে দেখি সেদিনের সেই নীলিমা সরকারও বসে আছেন। নমস্কার বিনিময় করে আম পাশের মোড়াটায় বসলাম। বীণামাসি চাদরটা গলা পর্যন্ত টেনে নিয়ে পাশ ফিরে বললে, জনিস নীলিমা, বাচ্চা আগে আমাদের পাড়াতেই থাকত। আমাদের এই পাড়ায় থাকবাযর সময়ই ওর মা মারা যান…