আমি আবার লিখলাম, সেন্টিমেন্টের লড়াই লড়বার ক্ষমতা আমার নেই। তবে আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছি, আমার কিছু চাই না। যদি নিতান্তই কিছু দিতে চান, তাহলে কনটেমপোরারি হিষ্ট্রর কিছু বই দেবেন। দয়া করে আর কিছু দিয়ে আমাকে বিব্রত করবেন না।
যাকগে ওসব কথা। মেমসাহেব কলকাতা যাবার আগের দিন দু’জনে বেড়াতে বেরিয়েছিলাম। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে শেষে বুদ্ধ-জয়ন্তী পার্কে বসেছিলাম অনেকক্ষণ। কথায় কথায় মেমসাহেব খোৰুনের কথা বলেছিল, তুমি কলকাতা ছেড়ে চলে আসার পর বুঝলাম তোমাকে কত ভালবাসি। এমন একটা অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা আমাকে ঘিরে ধরল যে তোমাকে কি বলব। কোনমতে সেই লেডিজ ট্রামে চেপে কলেজ যেতাম। আর আসতাম। আর কোথাও যেতাম না। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সিনেমা টিনেমা কিছু ভাল লাগত না।
আমি বললাম, ঠিক সেইজন্যই তো খোকনকে বেশী আঁকড়ে ধরেছ, তা আমি বুঝি।
তইতো সন্ধ্যার পর খোকনকে পড়াতে বসতাম। পড়াশুনা হয়ে গেলে খাওয়া-দাওয়ার পর ছাদে গিয়ে দুজনে বসে বসে গল্প করে কাটাতাম। কোন কোনদিন মা আসতেন। গান গাইতে বলতেন। কিন্তু আমি গাইতে পারতাম না। গান গাইবার মত মন আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম।
একটু পরে আবার বললো, গরমকালে কলকাতার সন্ধ্যাবেলা যে কি সুন্দর তা তো তুমি জান। তোমার সঙ্গে কত ঘুরে বেড়িয়েছি। ঐ সন্ধ্যাবেলায় কিন্তু তুমি চলে আসার পর আমি কলেজ থেকে ফিরে চুপচাপ শুয়ে থাকতাম আমার খাটে।
তাই বুঝি? সত্যি বলছি, জানিলা দিয়ে পাশের শিউলি গাছটা দেখতাম আর এক টুকরো আকাশ দেখতে পেতাম। শুয়ে শুয়ে ভাবতাম শুধু তোমার কথা।
আমি ওর হাতটা আমার হাতের মধ্যে টেনে নিলাম। বললাম, তুমি যে আমাকে ছেড়ে শান্তিতে থাকতে পার না, তা আমি জানি মেমসাহেব।
ওর চোখদু’টো কেমন যেন ছলছল করছিল। গলার স্বরটাও স্বাভাবিক ছিল না। তেজা তেজা গলায় বললো, এখন শুধু খোকন ছাড়া কলকাতায় আমার কোন আকর্ষণ নেই। কিন্তু ছেলেটা আজকাল যে কি লাগিয়েছে তা ওই জানে।
কি আবার লাগল?
মনে হচ্ছে খুব জোর পলিটিকস করছে।
তার জন্য ভয় পাবার বা চিন্তা করবার কি আছে?
তুমি কলকাতায় রিপোর্টারী করেছ, অনেক রাজনৈতিক, আন্দোলন দেখছি। সুতরাং তুলি দেখলে বুঝতে পারতে কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারি না ও কি করছে। সেইজন্যই বেশী ভয় হয়।
চুরি-জোচ্চারি তো করছে না, সুতরাং তুমি এত ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন?
মেমসাহেব দৃষ্টিটা একটু ঘুরিয়ে নিয়ে কেমন যেন অসহায়ার। মত আমার দিকে তাকাল। বললো, জান, এই ত কিছুদিন আগে হাতে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে ফিরল। প্ৰথমে কিছুই বলছিল না। বার বার জিজ্ঞাসা করার পর বললো, পুলিসের লাঠি লেগেছে। এবার মেমসাহেব আমার হাতদু’টো চেপে ধরে বললো, আচ্ছা! বলতে, ঐ লাঠিটাই যদি মাথায় লাগত, তাহলে কি সর্বনাশ হতো?
আমি বেশ বুঝতে পারলাম খোকন রাজনীতিতে খুব বেশী মেতে উঠেছে। সভা-সমিতি মিছিল-বিক্ষোত করছে সে এবং আজ হাতে লাঠি পড়েছে, কাল মাথায় পড়বে, পরশু হয়ত গুলীর আঘাতে আহত হয়ে মেডিক্যাল কলেজের অপারেশন থিয়েটারে যাবে। চিন্তার নিশ্চয়ই কারণ আছে কিন্তু এ-কথাও জানি ছেলেরা একবার মেতে উঠলে ফিরিয়ে আনা খুব সহজ নয়। খবরের কাগজের রিপোটারী করতে গিয়ে কলকাতার রাজপথে বহুজনকে পুলিশের লাঠিতে আহত, গুলীতে নিহত হতে দেখেছি। সব রিপোর্টারই এসব দেখে থাকেন, নিশ্চল নিশ্চপ পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেন। চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমিও সবকিছু দেখেছি, একফোটাও চোখের জল ফেলিনি।
আজ মেমসাহেব খোকনের কথা বলায় হঠাৎ মুহুর্তের জন্য এইসব দৃশ্যের ঝড় বয়ে গেল মনের পর্দায়ে। কেন, তা বুঝতে পারলাম না। মনে মনে বেশ একটু চিন্তিতও হলাম। ওকে সেসব কিছু বুঝতে দিলাম না। সান্ধনা জানিয়ে বললাম, হাতে একটু লাঠি লেগেছে বলে অত ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন? কলকাতায় বাস করে যে পুলিসের এক ঘা লাঠি খায়নি, সে খাটি বাঙালীই না।
দু। ফোটা চোখের জল ইতিমধ্যেই গড়িয়ে পড়েছিল মেমসাহেবের গালের পর। আমার কাছ থেকে লুকোবার জন্য তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে সারা মুখটা মুছে নিয়ে বললো, হয়ত তোমার কথাই ঠিক কিন্তু যদি কোনদিন কিছু হয়।…
মেমসাহেব। আর বলতে পারল না। দুই হাঁটুর পর মাথাটা রাখল। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম, আত ভয় পাচ্ছি কেন মেমসাহেব? আবার বললাম, অতি চিন্তা করলে কি বাঁচা যায়?
মেমসাহেব রাজনীতি করত না কিন্তু কলকাতাতে জন্মেছে, স্কুল-কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে। সুতরাং ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, অনেক কিছু দেখেছে। হয়ত গুলিতে মরতে দেখে নি কিন্তু লাঠি বা টিয়ার-গ্যাস বা ইট-পাটকেলের লড়াই নিশ্চয়ই অনেকবার দেখেছে। তাছাড়া খবরের কাগজও পড়ে, ছবি দেখে। সেই সামান্য অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই খোকন সম্পর্কে মেমসাহেব একটু অস্তির না হয়ে পারে নি।
ওয়েস্টার্ন কোটে ফিরে আসার পর আমি মেমসাহেবকে বলেছিলাম, তুমি বরং খোকনকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। এখানে পড়াশুনা করবে। আর আমাকেও একটু-আধটু সাহায্য করবে।
আমার প্রস্তাবে ও আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিল। বলেছিল, সত্যি ওকে পাঠিয়ে দেব?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, দাও।
কিন্তু…
কিন্তু কি?
ক’মাস পরেই তো ওর ফাইন্যাল।
আমি বললাম, ঠিক আছে। পরীক্ষা দেবার পরই পাঠিয়ে দিও, এখানে বি-এ পড়বে। w