আমি কোন উত্তর না দিয়ে শুধু একটু হাসলাম। একটু পরে বিদায় নিয়ে চলে এলাম ওয়েস্টার্ন কোর্ট।
পরের দিন স্টেশনে বিদায় জানাতে গেলে মেজদি আমাকে একটু আড়ালে ডেকে নিলেন। বললেন, আপনার মেমসাহেব বোম্বে দেখেনি। তাই সামনের ছুটিতে আমাদের কাছে আসবে। কদিনের জন্য দিল্লী পাঠিয়ে দেব, কেমন?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, আপকা মেহেরবানি। মেজদি বললেন, মেহেরবানির আবার কি আছে? বিয়ের আগে একবার সবকিছু দেখেশুনে যাক।
আমি এ-কথারও কোন জবাব দিলাম না। মাথা নীচু করে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলাম। ট্রেন ছাড়ার মুখে মেজদি বললেন, ফাল্গুনে বিয়ে হলে আপনার কোন আপত্তি নেই তো?
আমি মাথা নীচু করেই বললাম, সে-সময় যে পার্লামেন্টের বাজেট সেসন চলবে।
তা চলুক গে। বেশী দেরী আর ভাল লাগছে না। শেষে মেজদি বলেছিলেন, সাবধানে থাকবেন তাই। চিঠি দেবেন।
মেজদি চলে যাবার পর মনটা সত্যি বড় খারাপ লাগল। পরমাত্মীয়ের বিদায়-ব্যথা অনুভব করলাম মনে মনে।
কদিন পর মেমসাহেবের চিঠি পেলাম।
… তুমি কি কোন তুক-তাক বা কবচ-মাদুলী দিয়ে মেজদিকে বশ করেছ? ও মা-র কাছে ছ পাতা আর আমার কাছে চার পাতা চিঠি লিখেছে। সারা চিঠি ভর্তি শুধু তোমার কথা, তোমার প্রশংসা। তোমার মত ছেলে নাকি আজকাল পাওয়া মুশকিল। তুমি নাকি ওদের খুব যত্ন করেছ? ওরা নাকি খুব আরামে ছিল?
তারপর মা-র চিঠিতে ফাল্গুন মাসে বিয়ে দেবার কথা লিখেছে। তোমারও নাকি তাই মত? মা-র কোন আপত্তি নেই। আজ মেজদির চিঠিটা মা দিদির কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
আর ক’দিন পরেই আমাদের কলেজ বন্ধ হবে। ছুটিতে মেজদির কাছে যাব। যদি মেজদিকে ম্যানেজ করতে পারি। তবে ওদের কাছে দু সপ্তাহ থেকে এক সপ্তাহের জন্য তোমার কাছে যাব।
আমাদের এখানকার আর সব খবর মোটামুটি ভাল। তবে ইদানীং খোকনকে নিয়ে একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছি। আমার মনে হচ্ছে ও রাজনীতিতে মেতে উঠেছে। পড়াশুনা এখনও অবশ্য ঠিকই করছে কিন্তু ভয় হয় একবার যদি রাজনীতি নিয়ে বেশী মেতে ওঠে, তবে পড়াশুনার ক্ষতি হতে বাধ্য। খোকন যদি কোন কারণে খারাপ হয়ে যায়, তাহলে তার জন্য আমারও কিছুটা দায়ী হতে হবে। সর্বোপরি বৃদ্ধ বিপত্নীক কাকাবাবু বড় আঘাত পাবেন।…
আমি মেমসাহেবকে লিখলাম, মেজদি যা লিখেছে তা বর্ণে বর্ণে সত্য। ফাল্গুন মাসে পার্লামেন্টের সেসন চলবে। কিন্তু তা চলুক গে। চুলোর দুয়োরে যাক পার্লামেণ্ট। ফান্ধন মাসে আমি বিয়ে করবই। আমার আর দেরী সহ হচ্ছে না। তুমি যে আমার চাইতেও বেশী অধৈৰ্য হয়েছ, তা আমি জানি।
আরো অনেক কিছু লিখেছিলাম। শেষের দিকে খোকনের সম্পর্কে লিখেছিলাম, তুমি ওকে নিয়ে অত চিন্তা করবে না। বাঙালীর ছেলেরা যৌবনে হয় রাজনীতি, না হয় কাব্য-সাহিত্য চৰ্চা করবেই। শরৎ-হেমন্ত-শীত-বসন্ত ঋতুর মত এসব চিরস্থায়ী নয়। দু’চারদিন ইনকিলাব বা বন্দেমাতরম চিৎকার করে ডালহৌসী স্কোয়ারের স্ট্রম রোলারের তলায় পড়লে সব পাল্টে যাবে। খোকনও পাল্টে যাবে।
এ-কথাও লিখলাম, তুমি খোকনের জন্য অত ভাববে না। হাজার হোক আজ সে বেশ বড় হয়েছে, কলেজে পড়ছে। তাছাড়া তার বাবা তো আছেন। ছেলেমেয়েদের এই বয়সে তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে গেলে অনেক সময়েই হিতে বিপরীত হয়। তোমারও হতে পারে। সুতরাং একটু খেয়াল করে চলবে। শেষে লিখলাম, খোকন যখন ছোট ছিল, যখন তাকে মাতৃস্নেহ দিয়ে, দিদির ভালবাসা দিয়ে অতাবিত বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার প্রয়োজন ছিল, তুমি ও মেজদি তা করেছ। তোমাদের স্নেহচ্ছায়ায় যে একটা মাতৃহারা শিশু আজ যৌবনে পদার্পণ করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, সেইটুকুই তোমাদের যথেষ্ট পুরস্কার। এর চাইতে বেশী আশা করলে হয়ত দুঃখ পেতে পার।
জান দোলাবৌদি, খোকন সম্পর্কে এত কথা আমি লিখতাম না। কিন্তু ইদানীংকালে মেমসাহেব খোকনকে নিয়ে এত বেশী মাতামাতি, এত বেশী চিন্তা করা শুরু করেছিল যে-এসব না লিখে পারলাম না। আজকাল ওর প্রত্যেকটা চিঠিতে খোকনের কথা থাকত। লিখত, খোকনের এই হয়েছে, ঐ হয়েছে। খোকনের কি হলো, কি হবে? খোকন কি মানুষ হবে না? ইত্যাদি ইত্যাদি হাজার কথা লিখত। তুমি তো জান আজকালকার দিনে নিজেদের খোকনকেই মানুষ করতে মানুষ পাগল হয়ে উঠছে। তাছাড়া স্নেহ-ভালবাসা দেওয়া সহজ। কিন্তু বিনিময়ে তার মর্যাদা পাওয়া দুর্লভ।
খোকনের প্রতি ওর এত স্নেহ-ভালবাসার জন্য সত্যি আমার ভয় করত। তয় হতো। যদি কোনদিন খোকন ওর এই স্নেহভালবাসার মূল্য না নেয়, মৰ্যাদা না দেয়, তখন সে-দুঃখ, সে-আঘাত সহস্থ করা অত্যন্ত কষ্টকর হবে। তাই না?
এই চিঠির উত্তরে মেমসাহেব কি লিখল জান? লিখল, তুমি যত সহজে খোকন সম্পর্কে যেসব উপদেশ পরামর্শ দিয়েছ, আমার পক্ষে অত সহজে সেসব গ্রহণ করা বা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তার কারণ খুব সহজ। মাতৃহারা ছবছরের শিশু খোকনকে নিয়ে কাকাবাবু আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। সে অনেক দিনের কথা। মাতৃস্নেহ দেবার ক্ষমতা আমাদের ছিল না। কিন্তু দিদি, মেজদি আর আমি ওকে বড় করেছি। ওকে খাইয়েছি, পরিয়েছি, সুর করে ছড়া বলতে বলতে কোলের মধ্যে নিয়ে ঘুমিয়েছি। একদিন নয়, দুদিন নয়, বছরের পর বছর খোকনকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে শুয়েছি আমরা তিন বোনে।