গজাননকে আমার এই নতুন বাড়িতে থাকতে দিলাম। আমি ওকে বললাম গজানন, তুমি আমার বাড়িটার দেখাশুনা কর। আমি এর জন্য তোমাকে মাসে মাসে কিছু দেব।
গজানন সাফ জবাব দিয়েছিল, নেই নেই, ছোটোসাব, তুমি আমার হিসেবা-টিসেব করতে পারবে না। আমি বিবিজির কাছ থেকে যা নেবার তাই নেব।
গজানন বাসে যাতায়াত করত। ডিউটি শেষ হবার পর এক মিনিটও অপেক্ষা করত না। সোজা চলে যেত গ্রীনপার্ক।
আমি আমার বাড়তি আড়াইশ টাকা দিয়ে কেনাকাটা শুরু করে দিলাম। একটা সোফা সেট কিনলাম, একটা ডবল বেডের খাট কিনলাম। ওয়েস্টার্ন কোট থেকে আমার বইপত্তর ঐ বাড়িতে নিয়ে গেলাম। বিদেশ থেকে কিনে আনা ডেকরেশন পিসগুলোও সাজালাম।
তারপর এক মাসে সমস্ত ঘরের জন্য পর্দা করলাম। তাছাড়া যখন যেরকম বাতিক আর সামর্থ্য হয়েছে, তখন কটেজ ইণ্ডাষ্ট্রিজ এম্পোরিয়াম বা অন্য কোন স্টেট এম্পোরিয়াম থেকে কিছু কিছু জিনিসপত্র কিনে ঘরদের সাজাচ্ছিলাম।
গজানন বড় দরদ নিয়ে বাড়িটার দেখাশুনা করছিল। দীর্ঘদিন ওয়েস্টার্ন কোর্টে কাজ করার ফলে ওর বেশ একটা রুচিবোধ হয়েছিল। মানি প্যাণ্ট, ক্যাকটাস্, ফার্ন দিয়ে বাড়িটা চমৎকার সাজাল।
আমি যখনই দিল্লীর বাইরে গেছি, গজানন তখনই ফরমায়েশ করে ছোটখাট সুন্দর সুন্দর জিনিস আনিয়েছে। হায়দ্রাবাদ থেকে দশ-পনের টাকা দামের ছোট ছোট সুন্দর সুন্দর উড, কাতিং এনেছি, বেনারস থেকে পাথরের জিনিস। এনেছি, কলকাতা থেকে বঁকুড়ার টেরেকোটা ঘোড়া আর কৃষ্ণনগরের ডলস এনেছি। উড়িষ্যা থেকে স্যাগুস্টোনের কোনারক মূর্তি, কালীঘাট আর কাঁটকি পটিও এনেছিলাম। আমাদের ড্রইংরুমের জন্য।
বুক-সেলফ’এর উপর দু’কোনায় দু’টো ফটো রেখেছিলাম। একটা প্ৰাইম মিনিস্টারের সঙ্গে আমার ছবি আর একটা মেমসাহেবের প্রোর্ট্রেট।
এদিকে যে এতকাণ্ড করছিলাম, সেসব কিছুই মেমসাহেবকে জানালাম না। ইচ্ছা করেই জানালাম না। ইতিমধ্যে বোম্বে থেকে মেজদির কাছ থেকে চিঠি পেলাম—
ভাই রিপোর্টার,
যুদ্ধ না করেও যারা যোদ্ধা, ইণ্ডিয়ান নেভীর তেমনি এক অফিসারকে বিয়ে করে কি বিপদেই পড়েছি। সংসার করতে গিয়ে রোজ আমার সঙ্গে যুদ্ধ করছে, রোজ হেরে যাচ্ছে। রোজ বন্দী করছি, রোজ মুক্তি দিচ্ছি। তবে বার বার তো যুদ্ধ-বন্দীর প্রতি এত উদার ব্যবহার করা যায় না। এবার তাই শাস্তি দিয়েছি, দিল্লী ঘুরিয়ে আনতে হবে। তবে ভাই একথা স্বীকার করব বন্দী এক কথায়, বিনা প্ৰতিবাদে, শাস্তি হাসিমুখে মেনে নিয়েছে।
আর কিছুদিনের মধ্যেই তুমিও বন্দী হতে চলেছি। শাস্তি তোমাকেও পেতে হবে। তবে তুমি তোমার মেমসাহেবের কাছ থেকে শাস্তি পাবার আগেই আমরা দুজনে তোমাকে শাস্তি দেবার জন্য দিল্লী আসছি।
প্রেসিডেন্টের খুব ইচ্ছা কে আমরা রাষ্ট্রপতি ভবনে ওর অতিথি হুই। কিন্তু ভাই, তোমাকে ছেড়ে কি রাষ্ট্রপতি ভবনে থাকা ভাল দেখায়? তোমার মনে কষ্ট দিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে থাকতে আমি পারব না। আমাকে ক্ষমা করো।
আগামী বুধবার ফ্রন্টিয়ার মেল অ্যাটেণ্ড করতে ভুলে যেও না। তুমি স্টেশনে না এলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হয়েই আবার সেই রাষ্ট্রপতি ভবনে যেতে হবে।
তোমার মেজদি।
বুধবার আমি ফ্রন্টিয়ার মেল অ্যাটেণ্ড করেছিলাম। মেজদিদের নিয়ে এসেছিলাম আমার গ্রীনাপার্কের নতুন আস্তানায়। সারা জীবন কলকাতায় ঐ চারখানা ঘরের তিনতলার ফ্ল্যাটে কাটিয়ে আমার গ্রীনাপার্কের বাড়ি মেজদির ভীষণ পছন্দ হয়েছিল।
যুদ্ধ না করেও যিনি যোদ্ধা, মেজদির সেই ভাগ্যবান বন্দী ঘরবাড়ি দেখে মন্তব্য করেছিলেন, দেখেশুনে মনে হচ্ছে ম্যাডাম সপিং করতে গিয়েছেন। এক্ষুনি এসে ড্রইংরুমে বসে এককাপ কফি খেয়েই বেডরুমে লুটিয়ে পড়বেন।
তারপর জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ম্যাডামএর জন্য এত আয়োজন করার পর এ বাড়িতে আপনার একলা থাকতে কষ্ট হয় না?
আমি বলেছিলাম, আমি তো এখানে থাকি না। আমি ওয়েস্টার্ন কোটেই থাকি।
আমার কথায় ওরা দুজনেই অবাক হয়েছিল। বোধহয় খুশিও হয়েছিলেন। খুশি হয়েছিলেন এই কথা ভেবে যে একলা ভোগ করার জন্য আমি এত উদ্যোগ আয়োজন করিনি।
মেজদিরা তিনদিন ছিলেন। কখনো ওরা দুজনে, কখনও বা আমরা তিনজনে ঘুরে বেড়িয়েছি। ওদের দিল্লী ত্যাগের আগের দিন সন্ধ্যায় গ্রীন পার্কের বাড়ির ড্রইংরুমে বসে অনেক রাত্ৰি পৰ্যন্ত আমরা আড্ডা দিয়েছিলাম।
কথায় কথায় মেজদি একবার বললেন, সংসার করার প্রায় সবকিছুই তো আপনি যোগাড় করে ফেলেছেন। বিয়েতে আপনাদের কি দেব বলুন তো?
আমি উত্তর দেবার আগেই বন্দী উত্তর দিলেন, আজেবাজে কিছু না দিয়ে একটা ফোমড় রাবারের গদি দিও। শুয়ে আরাম পাবে আর প্রতিদিন তোমাকে ধন্যবাদ জানাবে।
এইসব আজেবাজে। আলতু-ফালতু কথাবার্তা বলতে বলতে অনেক রাত হয়েছিল। মেজদি বললেন, আজ আর ওয়েস্টার্ন কোট, যাবেন না, এইখানেই থেকে যান।
আমি হেসে বলেছিলাম, না, না, তা হয় না।
কেন হয় না?
ওখানে নিশ্চয়ই জরুরী চিঠিপত্র এসেছে…
মেজদি মাঝপথে বাধা দিয়ে বললেন, এত রাত্তিরে আর চিঠিপত্তর দেখে কি করবেন। কাল সকালে দেখবেন।
আবার বললাম, না, না, মেজদি, আমি এখন এ-বাড়িতে থাকব না।
এবার মেজদি হাসলেন। বললেন, কেন? প্ৰতিজ্ঞা করেছেন বুঝি যে, একলা একলা এই বাড়িতে থাকবেন না?