বিয়ে বাড়ি। ঘরে আরো অনেক লোকজনে ভর্তি ছিল। ওদের সবার সামনেই মেজদি আমার ঘাড়ে একটা ধাক্কা দিয়ে বললেন, নিন, মাকে প্ৰণাম করুন।
লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেল। কিন্তু কি করব? প্ৰণাম করলাম। এবার মেজদি আমার মাথাটা চেপে ধরে বললেন, নিন, এবার আমাকে প্ৰণাম করুন।
আমি প্রতিবাদ করলাম, আপনাকে কেন প্ৰণাম করব?
মেজদি চোখ রাঙিয়ে বললেন, আঃ। যা বলছি তাই করুন। তা নিয়ত সবকিছু ফাস করে দেব।
আশেপাশের সবাই গিলে গিলে মেজদির কথা শুনছিলেন। আর হাঁ করে আমাকে দেখছিলেন।
আমি এদিক-ওদিক বাঁচিয়ে অনেক কষ্টে মেজদিকে চোখ টিপে ইশারা করলাম।
ন্যাভাল অফিসারকে পেয়ে মেজদির প্রাণে তখন আনন্দের বন্যা। আমার ইশারাকে সে তখন গাহ্য করবে কেন? তাই সবার সামনেই বলে ফেললেন, ওসব ইশারা-টিসারা ছাডুন। আগে প্ৰণাম করুন—তা নয়ত…
দোলাবৌদি, তুমি আমার অবস্থাটা একবার অনুমান কর। বিয়ে বাড়ি। চারদিকে লোক’জন গিজগিজ করছে। তারপর ঐ রণমূৰ্তিধারী বধুবেশী মেজদি! বীরত্ব দেখিয়ে বেশী তর্ক করলে না। জানি হাটের মধ্যে হাঁড়ি ভেঙে মেজদি কি সর্বনাশই করত। টিপ করে একটা প্ৰণাম করেই পালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু মেজদি আবার টেনে ধরে বললেন, আহা-হা! একটু দাঁড়ান।
হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, ঐ যে দিদি দাঁড়িয়ে আছে। দিদিকে প্ৰণাম করুন।
আমি একটু ইতস্তত করতেই মেজদি আবার ভয় দেখালেন, খবরদার রিপোর্টার। অবাধ্য হলেই…
দিদিকেও প্ৰণাম করলাম।
দিল্লী আসার দিন মেমসাহেব স্টেশনে এসে বলেছিল, জান, তোমাকে সবার খুব পছন্দ হয়েছে।
স্টেশনে প্ল্যাটফর্মের সবার সামনেই ও আমাকে প্ৰণাম করল, আমি ওকে আশীৰ্বাদ করলাম। দিল্লী মেল ছেড়ে দিল।
১৭. মেজদির উপকার
মেজদি যে এত তাড়াতাড়ি আমাদের এত বড় উপকার করবেন, তা কোনদিন ভাবিনি। শুধু ভাবিনি নয়, কল্পনাও করিনি। মেমসাহেব আমাকে ভালবাসত, আমি মেমসাহেবকে ভালবাসতাম। সে ভালবাসায় কোন ফাকি, কোন ভেজাল ছিল না। আমরা নিশ্চিত জানতাম আমরা মিলবই। শত বাধা-বিপত্তি অগ্ৰাহ করেও আমরা মিলতাম।
কিন্তু তবুও মেজদির ঐ সাহায্য ও উপকারটুকুর একান্ত প্রয়োজন ছিল এবং মেজদির প্রতি আমরা দুজনেই কৃতজ্ঞ ছিলাম।
আসলে মেজদি বরাবরই আমাকে ভালবাসতেন, স্নেহ করতেন। আমারও মেজদিকে বড় ভাল লাগত। প্ৰথম দিন থেকেই মেজদিরও আমাকে ভাল লেগেছিল। কিছুদিনের মধ্যেই মেজদি আমাদের দুজনের ভালবাসার গভীরতা উপলব্ধি করেছিলেন। তাই মনে মনে ছোট বোনকে তুলে দিয়েছিলেন আমার হাতে।
এবার তো সারা দুনিয়াকে জানিয়ে দিলেন, মেমসাহেব আমার, আমি মেমসাহেবের। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তির হস্তান্তরের সবকিছু পাকাপাকি হয়ে গেল। শুধু এক সাবরেজিস্ট্রারের সই। আর সীলমোহর লাগান বাকি রইল। এই কাজটুকুর জন্য আমি বিশেষ চিন্তিত ছিলাম না।
মেমসাহেব অনেকদিন আগে বললেও আমি এতদিন বাড়ি ভাড়া নেবার কথা খুব সিরিয়াসলি ভাবিনি। সেবার কলকাতা থেকে ফিরে সত্যি সত্যিই গ্ৰীনপার্ক ঘোরাঘুরি শুরু করলাম, দু চারজন বন্ধু-বান্ধবকেও বললাম।
দু’চারটে বাড়ি দেখলাম। কিন্তু ঠিক পছন্দ হলো না। আরো কিছুদিন অপেক্ষা করলাম। আরো কিছু বাড়ি দেখলাম। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আরো কিছু পরামর্শ করলাম। কয়েকটা বাড়ির জন্য দরদস্তুরও করলাম।
এমনি করে আরো মাস দুই কেটে যাবার পর সত্যি সত্যিই তিনখানা ঘরের একটা ছোট কটেজ পেলাম তিনশ টাকায়। বাড়িটা আমার বেশ পুছন্দ হলো। মেহরালী রোড থেকে বড় জোর দুশো গজ হবে। গ্ৰীনপার্ক মার্কেট বেশ কাছে, মিনিট তিন-চারের রাস্তা। বাজার দূরে হলে মেমসাহেবের পক্ষে কষ্টকর হতো। তাছাড়া বাড়িটাই বেশ ভাল। কর্নার প্লাটু। সামনে আর পাশে মাঝারি সাইজের লন। গেটের ভিতর দিয়ে বুড়ির ভিতরে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা। ড্রইং-ডাইনিং রুমটা তো বেশ বড়। কুড়ি বাই পনের। একটা বেডরুম বড়, একটা ছোট। দু’টো বেডরুমেই লফটু আর ওয়ারড্রব। বড় বেডরুম আর ড্রইং-ডাইনিং রুমের মাঝে একটা ওয়েস্টার্ন স্টাইলের বাথরুম। বাড়ির ভিতরে একটা ইণ্ডিয়ান স্টাইলের প্ৰিভি। সামনের বারান্দাটা অনেকটা লম্বা থাকলেও বিশেষ চওড়া ছিল না। ভিতরের বারান্দাটা স্কোয়ার সাইজের বেশ। বড় ছিল। রান্নাঘর? দিল্লীর নতুন বাড়িতে যেমন হয়, তেমনিই ছিল। আলমারী-মিটসেফ-সিঙ্ক-কাপবোর্ড সবই ছিল। লেফট্ৰ, আলমারী ওয়ারড্রব থাকার জন্য আলাদা কোন স্টোর ছিল না। কিন্তু ছাদে একটা দরজা-বিহীন ঘর ছিল।
লন। দু’টো বেশ ভাল ছিল সত্যি। কিন্তু দিল্লীর অন্যান্য বাড়ির মত এই বাড়িটায় কোন ফুলগাছ ছিল না। আগে যিনি ভাড়া ছিলেন, তার নিশ্চয়ই ফুলের শখ ছিল না। তবে সামনের বারান্দার এক পাশ দিয়ে একটা বিরাট মাধবীলতা উঠেছিল।
মোটকথা সব মিলিয়ে বাড়িটা আমার বেশ ভাল লেগেছিল। তাছাড়া আমার মত ডাকাতের হাতে পড়ে মেমসাহেব ফ্যামিলি প্ল্যানিং এসোসিয়েশনের সভানেত্রী হলেও এ বাড়িতে থাকতে অসুবিধা হবে না বলে বাড়িটা আরো ভাল লেগেছিল।
বাড়িটা নেবার পর মেমসাহেবকে কিছু জানালাম না। ঠিক। করলাম ও দিল্লী আসার আগেই বেশ কিছুটা সাজিয়ে-গুছিয়ে নিয়ে চমকে দেব। আবার ভাবলাম, ওয়েস্টার্ন কোর্ট ছেড়ে এই বাড়িতেই। চলে আসি। পরে ভাবলাম, না, না, তা হয় না। একলা একলা। থাকব এই বাড়িতে? অসম্ভব। ঠিক করলাম। ওকে নিয়েই এই বাড়িতে ঢুকব।