কেন বলতো?
তা নয়ত এত রূপোর গহনা চাপিয়েছ কেন?
আমার খুব ভাল লাগে। কেন তোমার খারাপ লাগছে?
পাগল হয়েছ? খারাপ লাগবে কেন? খুব ভাল লাগছে।
সত্যি?
সত্যি ছাড়া কি মিথ্যা বলছি?
যাই হোক এত সাজলে কেন?
তোমার ভাল লাগবে বলে।
একটু থেমে আবার বললো, তাছাড়া…
তাছাড়া কি?
মুখটা একটু লুকিয়ে, বললো, ইউরোপ যাচ্ছ। না জানি কত মেয়ের সঙ্গে আলাপ হবে। তাই যাতে চট করে ভুলে না যাও…
আমাকে নিয়ে আজো তোমার এত ভয়?
আমাকে একটু আদর করে মেমসাহেব বললো, না গো না। এমনি সেজেছি।
সেদিন সন্ধ্যা-রাত্রি আর পরের দিনটা পুরোপুরি মেমসাহেবকে দিয়েছিলাম।
তারপর বিদায়ের দিন এয়ারপোর্ট রওনা হবার আগে মেমসাহেব আমাকে প্ৰণাম করেছিল, আমি ওকে আশীৰ্বাদ করেছিলাম। কিন্তু তবুও ও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মনে হলো যেন কিছু বলবে। জানতে চাইলাম, কিছু বলবে?
কিছু কথা না বলে মাথা নীচু করে ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে মুচকি মুচকি হাসছিল।
আমি ওর মুখটা আলতো করে তুলে ধরে আবার জানতে চাইলাম, কি, কিছু বলবে?
অনেকক্ষণ ধরে অনেকবার জিজ্ঞাসা করার পর হতচ্ছাড়ী আমার কানে কানে কি বলেছিল জান দোলাবৌদি? বলেছিল, আমাকে আর একটু ভাল করে আদর কর।
কি করব? বিদায়বেলায় এই অনুরোধ না রেখে আমি পারিনি। সত্যি একটু ভাল করেই আদর করলাম। আর ওর দেহে একটা চিহ্ন রেখে গেলাম, যে চিহ্ন শুধু মেমসাহেবই দেখেছিল। কিন্তু দুনিয়ার আর কেউ দেখতে পারে নি।
পালামের মাটি ছেড়ে আমি চলে গেলাম।
ঘুরতে ঘুরতে শেষে লণ্ডন পৌঁছে মেমসাহেবের চার-পাঁচটা চিঠি একসঙ্গে পেলাম। বার বার করে লিখেছিল, ফেরার সময় তুমি দিল্লীতে না গিয়ে যদি সোজা কলকাতা আস, তবে খুব ভাল হয়। কলেজে টেস্ট শুরু হয়েছে; সুতরাং এখন ছুটি নেওয়া যাবে না। অথচ তুমি ফিরবে। আর আমি তোমাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করব না, তা হতে পারে না।
শেষে লিখেছিল,তুমি কবে, কোন ফ্লাইটে, কখন দমদমে পৌঁছাবে, সে খবর আর কাউকে জানাবে না। দমদমে যেন ভিড় না হয়। শুধু আমিই তোমাকে রিসিত করব, আর কোন তৃতীয় ব্যক্তি যেন এয়ারপোর্টে না থাকে।
মেমসাহেব আমাকে বিদায় জানাবার জন্য কলকাতা থেকে দিল্লী ছুটে এসেছিল। সুতরাং আমি ওর এই অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারলাম না। বণ্ড স্ট্রীটে এয়ার ইণ্ডিয়া অফিসে গিয়ে আরো কিছু পেমেণ্ট করে টিকিটটা চেঞ্জ করে আনলাম। তারপর রওনা হবার আগে মেমসাহেবকে একটা কেবল করলাম, রিচিং ডামডাম এয়ার ইণ্ডিয়া স্যাটারডে মৰ্ণিং।। মজা করবার জন্য শেষে উপদেশ দিলাম, ডোন্ট ইনফর্ম এনিবডি।
সেদিন দমদমে অরেঞ্জ পাড়ের একটা তাঁতের শাড়ি আর অরেঞ্জ রং-এর একটা ব্লাউজ পরে, রোদপুরের মধ্যে মাথায় ঘোমটা দিয়ে ‘মেমসাহেব রেলিং এর ধারে দাঁড়িয়েছিল আমার আগমন প্ৰত্যাশায়। . আমার দুহাতে ব্রিফকেশ, টাইপরাইটার, কেবিনব্যাগ আর ওভারকোট থাকায় হাত নাড়তে পারলাম না। শুধু একটু মুখের হাসি দিয়ে ওকে জানিয়ে দিলাম, ফিরে এসেছি।
কাস্টমস ইমিগ্রেশন কাউন্টার পার হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতেই ও আমার হাত থেকে টাইপরাইটার আর কেবিনব্যাগটা নিয়ে নিল। টার্মিনাল বিল্ডিং থেকে বেরুবার সময় জিজ্ঞাসা করল, ভাল আছ তো?
মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, তুমি?
ভাল আছি।
তারপর ট্যাক্সিতে উঠে মেমসাহেব আমাকে প্ৰণাম করল।
আমি ওর মাথায় হাত দিয়ে বললাম, সুখে থাক, মেমসাহেব।
নিশ্চয়ই সুখে থাকব। তারপর আমি বলেছিলাম, জান, এই শাড়িটা আর ব্লাউজ পরে তোমাকে ভারী ভাল লাগছে।
খুব খুশি হয়ে হাসিমুখে ও বললো, সত্যি বলছ?
সত্যি বলছি। তোমাকে বড় শান্ত, স্নিগ্ধ, মিষ্টি লাগছে।
একটু পরে আবার বলেছিলাম, ইচ্ছা করছে তোমাকে জড়িয়ে ধরে একটু আদর করি।
মেমসাহেব দু’হাত জোড় করে বলেছিল, দোহাই তোমার, এই ট্যাক্সির মধ্যে আদর করো না।
দোলাবৌদি, এমনি করে এগিয়ে চলেছিলাম। আমি আর মেমসাহেব। আমি দিল্লীতে থাকতাম, ও কলকাতায় থাকত। কখনও লুকিয়ে-চুরিয়ে মেজদিকে হাত করে ও দিল্লী আসত, কখনও বা আমি কলকাতা যেতাম। মাঝে মাঝেই আমাদের দেখা হতো। বেশীদিন দেখা না হলে আমরাও শান্তি পেতাম না।
ইতিমধ্যে এক’জন ন্যাভাল অফিসারের সঙ্গে মেমসাহেবের মেজদির বিয়ে হলো। বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আমি কলকাতা গিয়েছিলাম। একটা ভাল প্রেজেনটেশনও দিয়েছিলাম।
মেজদির বিয়েতে গিয়ে ভালই করেছিলাম। এই উপলক্ষ্যে আমার সঙ্গে ওদের পরিবারের অনেকের আলাপ-পরিচয় হলো। তাছাড়া ঐ বিয়ে বাড়িতেই মেজদি আমাদের ব্যাপারটা পাকাপাকি করে দিয়েছিলেন। আমার হাত ধরে টানতে টানতে মেজদি ওর মার সামনে হাজির করে বলেছিলেন, হ্যাঁ মা, এই রিপোর্টারের সঙ্গে তোমার ঐ ছোটমেয়ের বিয়ে দিলে কেমন হয়? f
এমন অপ্ৰত্যাশিত ঘটনার জন্য আমি মোটেও প্ৰস্তুত ছিলাম না। লজ্জায় আমার চোখ-মুখ-কান লাল হয়ে উঠেছিল। তবুও আমি অনেক কষ্টে ভণিত করে বললাম, আঃ মেজদি! কি যা তা বলছেন? মেজদি আমাকে এক দাবিড় দিয়ে বললেন, আর ঢং করবেন। না। চুপ করুন।
তারপর মেজদি আবার বললেন, কি মা? তোমার পছন্দ হয়? এত সহজে ঐ কালো-কুচ্ছিত হতচ্ছাড়ী মেয়েটাকে যে আমার মত সুপাত্রের হাতে সমৰ্পণ করতে পারবেন, মেমসাহেবের মা তা স্বপ্নেও ভাবেন নি। তাই বললেন, তোদের যদি পছন্দ হয় তাহলে আর আমার কি আপত্তি থাকবে বল?