খবরটি সে বাজারে প্রায় অবিশ্বাস্য হলেও যাচাই করে দেখলাম, ঠিকই। দিল্লীর বাজার তখন অত্যন্ত গরম কিন্তু তবুও আমি খবরটা পাঠিয়ে দিলাম। ট্রাঙ্ককাল করে নিউজ এডিটরকে ব্রিফ করে। দিলাম। পরের দিন ডবল কলম হেডিং দিয়ে সেকেণ্ড লীড হয়ে ছাপা হলো, চৌ এন-লাই দিল্লী আসছেন।
এই খবরটা দেবার জন্য প্ৰায় সবাই আমাকে পাগল ভাবল। আমার এডিটরের কাছেও অনেকে অনেক বিরূপ মন্তব্য করলেন। এডিটর চিন্তিত হয়ে আমাকে ট্রাঙ্ককাল করলেন। আমি বললাম, একটু ধৈৰ্য ধরুন।
এক সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই লোকসভায় কোশ্চেন-আওয়ারের পর স্বয়ং প্রাইম মিনিস্টার ঘোষণা করলেন, প্রিমিয়ার চৌ এন-লাই তাঁর আমন্ত্রণ গ্ৰহণ করে সীমান্ত বিরোধ আলোচনার জন্য দিল্লী আসছেন।
বিনা মেঘে বজ্ৰাঘাত হলো অনেকের মাথায়। আমি কিন্তু আনন্দে ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করলাম। রাত্রে এডিটরের টেলিগ্ৰাম পেলাম, কনগ্রাফুলেশনস স্পেশ্যাল ইনক্রিমেন্ট টু-ফিফটি উইথ ইমিডিয়েট এফেকটু। দু’হাত তুলে ভগবানকে প্ৰণাম করলাম।
সেই রাত্ৰেই মেমসাহেবকে একটা টেলিগ্ৰাম করে সুখবরটা জানিয়ে দিলাম।
পরের দিন মেমসাহেবেরও একটা টেলিগ্ৰাম পেলাম, এ্যাকসেপ্টট কনগ্ৰাচুলেশনস অ্যাণ্ড প্ৰণাম স্টপ লেটার ফলোজ।
মেমসাহেবের চিঠি পাবার পরও ভাবতে পারিনি। ভবিষ্যতে আরো কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটবে আমার জীবনে। কিন্তু সত্যি সত্যিই ঘটল। প্ৰাইম মিনিস্টারের সঙ্গে ইউরোপ যাবার দুর্লভ সুযোগ এলে আমার জীবনে কয়েক মাসের মধ্যেই।
বিদায় জানাবার জন্য মেমসাহেব দিল্লী ছুটে এসেছিল। আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম। বলেছিলাম, আমাকে সী-অফ করার জন্য। তুমি কলকাতা থেকে দিল্লী এলে?
দুটি হাত দিয়ে আমার দুটি হাত দোলাতে দোলাতে বলেছিল, তুমি প্ৰথমবারের জন্য ইউরোপ যাচ্ছি। আর আমি চুপ করে বসে থাকব কলকাতায়?
ঐ কালো হরিণ চোখ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বললো, তাও আবার প্ৰাইম মিনিস্টারের সঙ্গে চলেছি। আমি না এসে থাকতে পারি?
পাগলীর কথাবার্তা শুনে আমার হাসি পেতো। কত হাজার হাজার লোক বিদেশ যাচ্ছে। তার জন্য এক হাজার মাইল দূর থেকে ছুটে এসে বিদায় জানাতে হবে?
দু’হাত দিয়ে আমার মুখখানা তুলে ধরে মেমসাহেব বললো, এসেছি, বেশ করেছি! তোমাকে কৈফিয়ত দিয়ে আসব?
বল দোলাবৌদি, অমন পাগলীর সঙ্গে কি তর্ক করা যায়? যায় না। তাই আমিও আর তর্ক করিনি।
পাশপোর্ট-ভিসা-ফারেন এক্সচেঞ্জ আগেই ঠিক ছিল। এয়ারপ্যাসেজ আগের থেকেই বুক করা ছিল। দুজনে মিলে এয়ার ইণ্ডিয়ার অফিসে গিয়ে টিকিটটা নেবার পর কিটনপ্লেসে। কয়েকটা ছোটখাট জিনিসপত্র কিনলাম। তারপর কফি হাউসে গিয়ে কফি খেয়ে ফিরে এলাম ওয়েস্টার্ন কোটে।
কেরার পথে মেমসাহেব বললো, দেখ তোমার কাজকর্ম আজই শেষ করবে। কালকে কোন কাজ করতে পারবে না।
কেন? কাল কি হবে? আমি জানতে চাইলাম। ঘাড় বেঁকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে ও বললো, বা: পরশু ভোরেই তো চলে যাবে। কালকের দিনটাও আমি পেতে পারি না?
লাঞ্চের পর একটু বিশ্রাম করে বেরিয়েছিলাম বাকি কাজগুলো শেষ করার জন্য। তারপর এক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্স মিনিস্ট্রিতে গিয়ে দেখাশুনা করে ফিরে এলাম সন্ধ্যার পরই।
এসে দেখি মেমসাহেব একটা চমৎকার বালুচরী শাড়ি পরেছে, বেশ চেপে কান ঢেকে চুল বেঁধেছে, বিরাট খোপায় রূপার কাঁটা গুজেছে। রূপার চেন’এ টিবেটয়ান লকেট লাগানো একটা হার ছাড়া আরো কয়েকটা রূপার গহনা পরেছে। কপালে টকটকে লাল একটা বিরাট টিপ ছাড়াও চোখে বোধ হয় একটু সুরমার টান লাগিয়েছিল।
আমি ঘরে ঢুকে মেমসাহেবকে দেখেই থমকে। দাঁড়ালাম। ও মুখটা একটু নীচু করে চোখটা একটু ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল। একটু হাসল।
আমি হাসলাম না, হাসতে পারলাম না। আগের মতই স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে রইলাম।
ও আবার আমার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসল। জিজ্ঞাসা করল, অমন স্থির হয়ে কি দেখছ?
তোমাকে।
ন্যাকামি করে ও আবার বললো, আমাকে?
বুঝতে পারছি না?
একটু হাসল। বললো, তা তো বুঝতে পেরেছি। কিন্তু অমন করে দেখবার কি আছে?
কেন দেখছি তা বুঝতে পারছি না? দেখবার কি কোন কারণ নেই?
মেমসাহেব। এবার আর তর্ক না করে ধীর পদক্ষেপে দেহটাকে একটু দুলিয়ে দুলিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। আমার হাত দু’টো ধরে মুখটা একটু বেঁকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, খুব খারাপ লাগছে?
আমি প্ৰায় চীৎকার করে উঠলাম, অসহ্য, অসহ্য!
সত্যি খারাপ লাগছে? অত খারাপ কি না তা জানি না, তবে তোমাকে আমি সহ্য করতে পারছি না।
ও এবার সত্যি একটু চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করল, এসব খুলে ফেলব?
এতক্ষণ ও আমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। এবার ওকে পাশে টেনে নিয়ে বললাম, হে নিরুপমা, চপলতা আজি যদি ঘটে তবে করিয়ো ক্ষমা… আর হে নিরুপমা, আঁখি যদি আজ করে অপরাধ, করিয়ো ক্ষমা।
দোলাবৌদি, মেমসাহেবও কোন কথা বলল না। দুটি হাত দিয়ে আমার হাতটা জড়িয়ে ধরে মাথাটা হেলান দিয়ে খুব মিহিমুরে গাইল, আমি রূপে তোমায় তোলাব না ভালবাসায় ভোলাব।
আমি প্রশ্ন করলাম, আর কি করবে? মেমসাহেব গাইতে গাইতে বললো, ভরাব না। ভূষণভারে, সাজাব না। ফুলের হারে-সোহাগ আমার মালা করে গলায় তোমার দোলাব।
আমি বললাম, সত্যি?
হাজারবার লক্ষবার সত্যি।
মেমসাহেব গজাননকে ডেকে চায়ের অর্ডায় দিল। চা এলো। চা খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কি এয়ার ইণ্ডিয়া বা টুরিস্টবুরোর চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছ?