একটু মুচকি হাসলেও বেশ সিরিয়াসলি বললাম, বাজে না মেমসাহেব। বিয়ের পর বোধহয় তোমাকে ছেড়ে আমি পার্লামেন্ট বা অফিসেও যেতে পারব না।
এবার মেমসাহেব একটু মুচকি হাসে। বললে, চব্বিশ ঘণ্টা বাড়ি বসে কি করবে?
আবার কানে কানে ফিসফিস করে বললাম, তোমাকে নিয়ে শুয়ে থাকব।
ও হেসে বললে, অসভ্য কোথাকার! একটু থেমে আবার বললে, শুতে দিলে তো?
আমি বললাম, শুতে না দিলে আমি চীৎকার করে, কান্নাকাটি করে। সারা পাড়ায় জানিয়ে দেব।
মেমসাহেব এবার আমার পাশ থেকে উঠে পড়ে। মুখ টিপে হাসতে হাসতে বললে, বাপরে বাপ! কি অসভ্য।
আমি দৌড়ে গিয়ে ওকে ধরতে গেলাম। ও ছুটে বারান্দায় বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করল, পারল না। আঁচল ধরে টানতে টানতে নিয়ে এলাম সোফার ওপর। যদি বলি এখনই……
হাতে ঘুষি পাকিয়ে বললে, নাক ফাটিয়ে দেব।
সত্যি?
এমনি করে মেমসাহেবের দিল্লীবাসের মেয়াদ ধীরে ধীরে শেষ হয়ে গেল। রবিবার বিকেলে ডিলুক্স এয়ার কণ্ডিসনড এক্সপ্রেসে কলকাতা চলে গেল। ওয়েস্টার্ন কোর্ট থেকে স্টেশন রওনা হবার আগে মেমসাহেব আমাকে প্ৰণাম করল, আমার বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরে একটু কাঁদল।
আমি ওকে আশীৰ্বাদ করলাম, আদর করলাম, চোখের জল মুছিয়ে দিলাম।
এক সপ্তাহ ধরে দুজনে কত কথা বলেছি কিন্তু সেদিন ওর বিদায় মুহুর্তে দুজনের কেউই বিশেষ কথা বলতে পারিনি। আমি শুধু বলেছিলাম, সাবধানে থেকে। ঠিকমত চিঠিপত্র দিও।
ও বলেছিল, ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করে। তোমার শরীর কিন্তু ভাল না।
শেষে নিউ দিল্লী স্টেশনে ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগে বলেছিল, তুমি কিন্তু আমাকে বেশীদিন একলা রেখো না। কলকাতায় আমি একলা থাকতে পারি না।
মেমসাহেব চলে গেল। আমি আবার ওয়েস্টার্ন কোটের শূন্যঘরে ফিরে এলাম। মনটা ভীষণ খারাপ লাগল। খেতে গেলাম না। ডাইনিং হলে আমাকে দেখতে না পেয়ে গজানন এলো আমার ঘরে খবর নিতে। আমাকে অনেক অনুরোধ করল কিন্তু তবুও আমি খেতে গেলাম না। বললাম, শরীর খারাপ। গজানন আমার মনের অবস্থা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছিল। সেজন্য সেও আর দ্বিতীয়বার অনুরোধ না করে বিদায় নিল।
কলকাতা থেকে মেমসাহেবের পৌঁছনো সংবাদ আসতে না আসতেই আমি আবার কাজকর্ম শুরু করেছিলাম। পুরো একটা সপ্তাহ পার্লামেণ্ট যাইনি, সাউথ ব্লক-নর্থ ব্লক যাইনি, মন্ত্রী-এম-পি-অফিসার-ডিপ্লোম্যাট দর্শন করিনি। এমন কি টাইপ রাইটার পৰ্যন্ত সম্পর্শ করিনি।
দু’একদিন এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করলাম। কিন্তু বিশেষ উল্লেখযোগ্য কোন খবর-টাবর পেলাম না। পার্লামেণ্টে তখন আকশাই চীন সড়ক নিয়ে ঝড় বইছিল প্ৰায়ই। প্ৰাইম মিনিস্টারও বেশ গরম গরম কথা বলছিলেন মাঝে মাঝেই। দু’চারজন পলিটাসিয়ান যুদ্ধ করবার পরামর্শ দিলেও প্রাইম মিনিস্টার তা মানতে রাজী হলেন না। অথচ এইভাবে বক্তৃতার লড়াই কতদিন চলতে পারে? অল ইণ্ডিয়া রেডিও আর পিকিঙ বেতারের রাজনৈতিক মল্লযুদ্ধ তেতো হয়ে উঠেছিল। লড়াই করার কোন উদ্যোগ, আয়োজন বা মনোবৃত্তি সরকারী মহলে না দেখায় আমার মনে স্থির বিশ্বাস হলো আলোচনা হতে বাধ্য।
দু’চারজন সিনিয়র ক্যাবিনেট মিনিস্টারের বাড়িতে আর অফিসে কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করে কোন কিছুর হদিশ পেলাম না। শেষে সাউথ ব্লকে ঘোরাঘুরি শুরু করলাম। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারী ও স্পেশ্যাল সেক্রেটারীকেও তেল দিয়ে কিছু ফল হলো না।
শেষে আশা প্ৰায় ছেড়ে দিয়েছি। এমন সময়—
আফ্রিকা ডেক্সের মিঃ চোপরার সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বেরুতে বেরুতে প্ৰায় সাড়ে ছাঁটা হয়ে গেল। বেরুবার সময় প্ৰাইম মিনিস্টারের ঘরের সামনে উঁকি দিতে গিয়ে দেখলাম, প্ৰাইম মিনিস্টার লিফট’এ ঢুকেছেন। আমি তাড়াতাড়ি হুড়মুড় করে লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম।
প্ৰাইম মিনিস্টার গাড়ির দরজার সামনে এসে গিয়েছেন, পাইলট তার মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিয়েছে, আয়ারলেস আর সিকিউরিটি কারও স্টার্ট দিয়েছে কিন্তু চলতে শুরু করে নি, এমন সময় ফরেন সেক্রেটারী প্ৰায় দৌড়তে দৌড়তে এসে হাজির হলেন। কানে কানে প্ৰাইম মিনিস্টারের সঙ্গে কি যেন কথা বললেন। প্ৰাইম মিনিস্টার আর ফরেন সেক্রেটারী আবার লিফটএ চড়ে উপরে চলে গেলেন।
আমি একটু পাশে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখলাম। বুঝলাম, সামথিং ভেরী সিরিয়াস অথবা সামথিং ভেরী আর্জেণ্ট। তা নয়ত ঐভাবে ফরেন সেক্রেটারী প্ৰাইম মিনিস্টারকে অফিসে ফেরত নিয়ে যেতেন না।
আমি প্ৰাইম মিনিস্টারের অফিসের পাশে ভিজিটার্স রুমে বসে রইলাম। দেখলাম, বিশ-পাঁচিশ মিনিট পরে প্রাইম মিনিস্টার আবার বেরিয়ে গেলেন। প্ৰাইম মিনিস্টারকে এবার দেখে মনে হলো, একটু যেন স্বস্তি পেয়েছেন মনে মনে।
আমি আরো কয়েক মিনিট অপেক্ষা করলাম। দেখলাম প্রাইম মিনিস্টার চলে যাবার পর পরই চায়না ডিভিশনের জয়েণ্ট সেক্রেটারী মিঃ মালিক ফরেন সেক্রেটারীর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
আমার আর বুঝতে বাকি রইল না চীন সম্পর্কেই কিছু জরুরী খবর এসেছে।
সেদিনকার মত আমি বিদায় নিলাম। পরের দিন থেকে মিঃ মালিকের বাড়ি আর অফিস ঘুরঘুর করা শুরু করলাম। তবুও কিছু সুবিধা হলো না।
শেষে ইউনাইটেড নেশনস ডিভিশনের এক’জন সিনিয়র অফিসারের কাছে খবর পেলাম সীমান্ত বিরোধ আলোচনার জন্য চীনা প্ৰধানমন্ত্রী চৌ এন-লাইকে দিল্লী আসার আমন্ত্রণ জানান হয়েছে এবং তিনি তা গ্ৰহণ করেছেন।