মেমসাহেব বলেছিল, অনেক বেলা হলো। চলো লাঞ্চ খেয়ে আসি।
আমি সোজা জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমি ঘর ছেড়ে বেরুচ্ছি না।
তবে?
তবে আবার কি? বেয়ারাকে ডেকে বলা ঘরে খাবার দিয়ে যেতে।
আমি অতীত দিনের রাজপ্রাসাদের রাজকুমারের শয়নকক্ষে মহারাজার মত শুয়ে রইলাম। ও বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে ডেকে বললে, সাহাবকা তবিয়ত আচ্ছা নেই হ্যায়। মেহেরবানি কারকে খানা ইধারই লে-আনা।
জো হুকুম মেমসাব।
ঘরে খাবার এসেছিল। সেন্টার টেবিলে খাবার-দাবার সাজিয়ে ও ডাক দিয়েছিল, এসে খেতে এসে।
বড় সোফায় দুজনে পাশাপাশি বসে খেয়েছিলাম। খেতে। খেতে এক টুকরো নরম মাংস আমার মুখে তুলে দিয়ে বলেছিল, এই নাও খেয়ে নাও।
তুমি খাও না।
আমি দিচ্ছি, তুমি খাও না।
মাংসের টুকরোটা খাবার সময় ওরা দু’টো আঙুলে কামড় দিয়ে বললাম, তোমাকেও খেয়ে ফেলি।
হাসতে হাসতে বললে, আমাকে কি খেতে বাকি রেখেছ?
খেয়ে-দোয়ে ও একটা চাদর গায় দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। সতর্ক করে দিল, এখন চুপটি করে ঘুমোও, একটুও বিরক্ত করবে না।
সত্যি?
সত্যি নয়ত কি মিথ্যে?
আমি একটু ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম, বিরক্ত না করে। যদি তোমাকে সুখী করি?
আমাকে হাত দিয়ে একটা ধাক্কা দিয়ে হেসে বললে, দূর থেকে সুখী করে।
অনেক দূরে সরে যাব?
হ্যাঁ, যাও।
তই কি হয়? তোমার কষ্ট হবে।
বুড়ো আঙুলটা দেখিয়ে বললে, কলা হবে। দেখি কেমন যেতে পার!
মেমসাহেব জানত ও পাশ ফিরে শুয়ে থাকতে পারবে না, আমিও দূরে সরে থাকব না। ওর মনের কথা আমি জানতাম, আমার মনের কথাও ও জানত। তবুও হয়ত একটু বেশি আদর, একটু বেশি ভালবাসা পাবার জন্য ও এমনি দুষ্টুমি করতে ভালবাসত। আমারও মন্দ লগত না।
পরের দিন সারা গেস্টহাউস ফাঁকা হয়েছিল। শুধু আমরা দুজন্ম আর দোতলায় এক বৃদ্ধ দম্পতি ছাড়া আর কোন গেস্ট ছিল না।
সন্ধ্যাবেলায় আমরা দুজনে লেকের ধার দিয়ে পাহাড় আর অরণ্যের মধ্যে কত ঘুরে বেড়িয়েছিলাম। মেমসাহেব কত গান শুনিয়েছিল। রাত্রে ফিরে এসে ছাতের কোণে লেকের মিষ্টি হাওয়ায় বসে বসে দুজনে ডিনার খেলাম। তারপর লাইটগুলো অফ করে দিয়ে বিরাট মুক্ত আকাশের তলায় বসে রইলাম। আমরা দুজনে। আকাশের তারাগুলো মিট-মিট করে জ্বললেও সেদিন ঐ আবছা অন্ধকারে আমাদের দুজনের মনের আকাশ পূর্ণিমার আলোয় ভরে গিয়েছিল।
আশপাশে দুনিয়ার আর কোন জনপ্ৰাণী ছিল না। মনে হয়েছিল। শুধু আমরা দুজনেই যেন এই বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের মালিক। ভগবান যেন আমাদের মুখ চেয়ে, আমাদের শান্তির জন্য আর সবাইকে ছুটি দিয়েছিলেন এই পৃথিবী থেকে অন্য কোথাও একটু ঘুরে আসতে।
জনারণ্যের বাইরেও এর আগে কয়েকবার মেমসাহেবকে কাছে পেয়েছি কিন্তু এমন করে কাছে পাইনি। এত পূর্ণ, পরিপূর্ণ সম্পূর্ণভাবে আগে পাইনি।
মেমসাহেব, ভুলে যাবে নাতো এই রাত্রির কথা?
বোতল বোতল ভালবাসার হুইস্কি খেয়ে মেমসাহেবের এমন নেশা হয়েছিল যে কথা বলার ক্ষমতাও ছিল না। তাইতো শুধু মাথা নেড়ে বললে, না।
কোনওদিন না?
না।
যদি কোনদিন তুমি আমার থেকে অনেক দূরে চলে যাও—
তোমার এই ভালবাসা আর এই স্মৃতি বুকে নিয়ে কোথায় যাব বলে?
তবুও মানুষের অদৃষ্টের কথা তো বলা যায় না।
জিভ দিয়ে ঠোঁটটা একটু ভিজিয়ে নিল, দু’টো দাঁত দিয়ে এ ঠোঁটের কোনাটা একটু কামড়ে নিল মেমসাহেব। তারপর বললো, তোমার এই ভালবাসা পাবার পর আর একজনের সঙ্গে সারাজীবন ধরে ভালবাসার অভিনয় করতে আমি পারব না।
একটু থামল। আমাকে আর একটু কাছে টেনে নিল। একটু বেশি শক্ত কয়ে জড়িয়ে ধরে বললে, তাছাড়া তোমার জীবনটা সর্বনাশ করে আর এক’জনকে আবার ঠকাব কেন? একটু জোর গলায় বলে উঠল, না, না, আমি তা কোনদিন পারব না।।
আমিও যেন কেমন হয়ে গিয়েছিলাম। আমিও বেশ জোর করে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। একটু যেন ভেজা গলায় বলেছিলাম, সত্যি বলছি মেমসাহেব, ভগবানের কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি সে দুর্দিন যেন কোনদিন না আসে। কিন্তু যদি কোনদিনূ, আসে, সেদিন আমি আর বাঁচিব না। হয় উন্মাদ হবো নয়ত তোমার স্মৃতি বুকে নিয়েই এই লেকের জলে চিরকালের জন্য ডুব দেব।
ও তাড়াতাড়ি আমার মুখটা চেপে ধরল। বললে, ছি, ছি, ওকথা মুখে আনে না। এই তোমার বুকে হাত দিয়ে বলছি আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না।
একটু থেমে, আমাকে একটু আদর করে মেমসাহেব। আবার বলেছিল, আমি যেতে চাইলেই তুমি আমাকে যেতে দেবে কেন? আমি না তোমার স্ত্রী? তোমার মনে কোন দ্বিধা, কোন চিন্তা থাকলে আজ এই রাত্তিরেই তুমি আমার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দাও, হাতে শাঁখা পরিয়ে দাও। আমি সেই শাঁখা-সিঁদুর পরেই কলকাতা ফিরে যাব।
মেমসাহেবের কথায় আমার মন থেকে অবিশ্বাসের ছোট্ট ছোট্ট টুকরো টুকরো মেঘগুলো পর্যন্ত কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। আমার মুখটা হাসিতে ঝলমল করে উঠল। বললাম, না, না, আমার মনে কোন দ্বিধা নেই। তুমি যদি আমার না হতে তাহলে কি আমন। হাসিমুখে তোমার সমস্ত সম্পদ, সব ঐশ্বৰ্য আর ভালবাসা এমন। করে দিতে?
কথায় কথায় অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। হাতে ঘড়ি ছিল কিন্তু দেখার মনোবৃত্তি কারুরই ছিল না। ঘরে এসে আর মেমসাহেব পােশ ফিরে শুয়ে দূরে থাকেনি। এত আপন, এত নিবিড়, এত ঘনিষ্ঠ হয়েছিল সে রাত্রে যে সে কাহিনী লেখা সম্ভব নয়। শুধু জেনে রাখা আমাদের দুটি মন, দুটি প্ৰাণ, দুটি আত্মা আর আশাআকাঙ্ক্ষার, স্বপ্ন-সাধনা সব একাকার হয়ে মিশে গিয়েছিল। সে চিরস্মরণীয় রাত্রে।
১৬. ঘুম ভাঙতে অনেক বেলা হয়েছিল
পরের দিন ঘুম ভাঙতে অনেক বেলা হয়েছিল। হয়ত আরো অনেক বেলা হতো। কিন্তু সূর্ষের আলো চোখে পড়ায় আমার ঘুম ভেঙে গেল। পাশের খাটে মেমসাহেব আমার দিকে ফিরে–শুয়েছিল। সূর্যের আলো ওর চোখে পড়ছিল না। মনে হলো মহানন্দে স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে।