ও একবার ঘাড় বেঁকিয়ে সানগ্রাসের মধ্য দিয়ে আমাকে দেখে নিয়ে বললো, হ্যাঁ। একটু থেমে জানতে চাইল, আপনি?
ভদ্রমহিলা বত্ৰিশ পাটি দাঁত বার করে বললেন, আমরাও বাঙালী।
আমি মনে মনে বললাম, এখানেও কি একটু নিশ্চিন্তে থাকতে পারব না?
ভদ্রমহিলা থামলেন না। আবার প্রশ্ন করলেন, কোথায় থাকেন আপনারা?
মেমসাহেব অস্বস্তিবোধ করলেও ভদ্রমহিলার আগ্রহের তৃষ্ণা না মিটিয়ে আসতে পারছিল না। বল্লো, দিল্লী।
দিল্লীতে? কোথায়? লোদী কলোনী?
না, ওয়েস্টার্ন কোটে।
আপনার স্বামী কি গভর্ণমেণ্টে আছেন?
না, উনি জার্নালিস্ট।
বেয়ারা ঘরের দরজা খুলে অ্যাটাচিটা রেখে দিল। আমি এবার ডাক দিলাম, শোন।
মেমসাহেব মাথার ঘোমটাটা একটু টেনে বললে, এখন আসি। পরে দেখা হবে।
আমরা আজ বিকেলেই আজমীঢ় চলে যাব।
আজই? মেমসাহেব মনে মনে দুঃখ পাবার ভান করল।
ও ঘরের দরজায় আসতেই আমি বললাম, তুমি ওকে বলো এক্ষুনি বিদায় নিতে।
সানগ্লাসটা খুলতে খুলতে ও বললে, আঃ, শুনতে পাবেন। মেমসাহেব চুল খুলতে বসল। আমি বাথরুমে ঢুকলাম। স্নান সেরে বেরিয়ে আসতেই ও আমাকে বললে, তুমি সাবান, তোয়ালে নিয়ে যাওনি?
বাথরুমেই তো ছিল। ওতো হোটেলের তাতে কি হলো? কাচান তোয়ালে নতুন সাবান ব্যবহার করলে কি হয়েছে?
কিছু হোক। আর নাই হোক, আমার তোয়ালে-সাবান থাকতে তুমি কেন হোটেলের জিনিস ব্যবহার করবে?
মেমসাহেবও স্নান সেরে নিল। বেয়ারাকে ডেকে বললাম,
নাস্তা লে অ্যাও।
ব্রেকফাস্ট খেয়ে সোফায় এসে বসলাম দুজনে। মেমসাহেবকে বললাম, একটা গান শোনাও।
চারিদিকে লোক’জন ঘোরাঘুরি করছে। এখন নয়, সন্ধ্যাবেলায় পাহাড়ের পাশ দিয়ে লেকের ধারে বেড়াতে বেড়াতে তোমাকে অনেক গান শোনাব।
সেদিন সারাদিন মেমসাহেবের গলার রবীন্দ্ৰসঙ্গীত শোনা হয় নি। সত্য। কিন্তু ভবিষ্যৎ জীবনের সঙ্গীত রচনা করেছিলাম দুজনে।… ওগো, এর পর তোমার আর কিছু আয় বাড়লেই তুমি একটা থ্রি-রুম ফ্ল্যাট নেবে।
এখনই ফ্ল্যাট নিয়ে কি হবে?
দুজনেই আস্তে আস্তে সংসারের সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে নেব।
তাছাড়া থ্রি-রুম ফ্লাট নিয়ে কি হবে? একটা ঘরের একটা ছোট্ট ইউনিট হলেই তো যথেষ্ট।
‘না, না, তা হয় না। একটা ঘরের ফ্ল্যাটে আমাদের দুজনেরই তো হাত-পা ছড়িয়ে থাকা অসম্ভব।
দুজন ছাড়া তিনজন পাচ্ছি কোথায়?
এবার মেমসাহেবের সব গাম্ভীৰ্য উধাও হয়ে গেল। হাসতে হাসতে বললে, তোমার মত ডাকাতের সঙ্গে সংসার করতে শুরু করলে দুজন থেকে তিনজন, তিনজন থেকে চারজন পাঁচজন হতেও সময় লাগবে না।
ওর কথা শুনে আমি স্তম্ভিত না হয়ে পারলাম না। অবাক বিস্ময়ে আমি ওর দিকে চেয়ে রইলাম।
আমন হাঁ করে কি দেখছ?
তোমাকে।
আমাকে?
মাথা নেড়ে বললাম, হুঁ, তোমাকে।
আমাকে কোনদিন দেখনি?
ওর দিকে চেয়ে চেয়েই বললাম, দেখেছি।
এবার মেমসাহেবও একটু অবাক হয়ে আমার দিকে চাইল। তবে অমন করে আমার দিকে চেয়ে চেয়ে কি দেখছি?
আমি দু’হাত দিয়ে ওর মুখখান তুলে ধরে বললাম, জান মেমসাহেব, তুমি নিশ্চয়ই সুখী সার্থক স্ত্রী হবে। কিন্তু সন্তানের জননী হিসাবে বোধহয় তোমার তুলনা হবে না।
মেমসাহেব প্ৰথমে ধীরে ধীরে দৃষ্টিটিা নামিয়ে নিল। তারপর আলতো করে মাথাটা আমার বুকের পর রাখল। দু’টো আঙুল দিয়ে পাঞ্জাবির বোতামটা ঘুরাতে ঘুরাতে বললে, আমার যে ছেলেমেয়ের ভীষণ শখ। রাস্তা-ঘাটে ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চা দেখলেই মনে হয়…
যদি তোমার হতো, তাই না?
মেমসাহেব আমার কথায় সম্মতি জানিয়ে মাথা নেড়ে হাসিল।
তারপর আস্তে আস্তে ওর মুখটা আমার কোলের মধ্যে লুকিয়ে ফেলল। আমার মনে হলো কি যেন লজ্জায় বলতে পারছে না। জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু বলবো?
মুখটা লুকিয়ে রেখেই আস্তে আস্তে বললে, তোমার ইচ্ছা! করে না?
আমি হোসে ফেললাম। জান মেমসাহেব, স্বপ্ন দেখতে বড় ভয় হয়।
আমার কোলের মধ্যে লুকিয়ে রাখা মুখটা ঘুরিয়ে আমার দিকে চাইল। বললে, কোন ভয় হয়?
জীবনে চলতে গিয়ে বারবার পিছনে পড়ে গেছি। তাইতো ভবিষ্যতের কথা ভাবতে, ভবিষ্যৎ জীবনের স্বপ্ন দেখতে ভয় হয়।
ও হাত দিয়ে আমার মুখটা চেপে ধরে বললে, না, না, ভয়ের কথা বলে না। ভয় কি? একটু আতঙ্কে, একটু দ্বিধাগ্ৰস্ত হয়ে জানতে চাইল, আমি কি তোমার হবে না?
এবার আমি ওর মুখটা চেপে ধরে বললাম, ছি, ছি, ওসব আজেবাজে কথা ভাবছ কেন? তুমি তো আমারই।
ওর মুখে তখনও বেশ চিন্তার ছাপ। বললো, সে তো জানি কিন্তু তবুও তুমি ভয় পাচ্ছি কেন?
আমি দু’হাত দিয়ে ওকে বুকের মধ্যে তুলে নিলাম। সাস্তুনা জানালাম, কিছু ভয় করো না। তোমার স্বপ্ন, তোমার ভালবাসা কোনদিন ব্যর্থ হতে পারে না।
একটু ব্যাকুলতা মেশানো স্বরে বললে, সত্যি বলছ?
একশ’বার বলছি। যদি বিধাতার ইচ্ছা না হতো তাহলে কি ঐ আশ্চৰ্য ভাবে আমাদের দেখা হতো? নাকি এমনি করে আজ আমরা সিলিসের লেকের পাড়ে মিলতে পারতাম?
আমারও তো তাই মনে হয়। যদি ভগবানের কোন নির্দেশ, কোন ইঙ্গিত না থাকত। তাহলে সত্যি আমরা কোনদিন মিলতে পারতাম।
তবে এত ঘাবড়ে যাচ্ছে কেন?
অনুযোগের সুরে মেমসাহেব বললে, তুমিই তো ঘাবড়ে দিচ্ছ।
ঘাবড়ে দিচ্ছি না, সতর্ক করে দিচ্ছি।
দু’ আঙুল দিয়ে আমার গালটা চেপে ধরে বললে, কি আমার সতর্ক করার ছিরি!
দোলাবৌদি, সেই অরণ্য আর পর্বতের কোলে যে দুটি দিন কাটিয়েছিলাম, তা আমার জীবনের মহা স্মরণীয় দিন। এত আপনার করে, এত নিবিড় করে মেমসাহেবের এত ভালবাসা আমি এর আগে কোনদিন পাইনি। ঐ দুটি দিন প্রতিটি মুহূর্ত মেমসাহেবের ভালবাসা আর উষ্ণ সান্নিধ্য উপভোগ করেছিলাম। আমি। তাইতো তৃতীয় কোন ব্যক্তির সাহচর্যে আসতে মন চায় নি।