ও মনে মনে আগে থেকেই সিদ্ধান্ত করে রেখেছিল। তাইতো মুহুর্তের মধ্যে উত্তর দিল, স্ট্যাণ্ডার্ড হেরল্ড।
তোমার বুঝি স্ট্যাণ্ডার্ড হেরল্ড খুব পছন্দ, আমি জানতে চাইলাম।
গাড়িটা দেখতেও ভাল, তাছাড়া…
।মেমসাহেব এগুতে গিয়ে একটু থামল। তাই আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তাছাড়া কি?
হাসি হাসি মুখে ও উত্তর দিল, ঐ গাড়িটা যে টু-ডোর। তাতে কি হলো? যেন মহা বোকামি করেই ঐ প্রশ্নটা করেছিলাম, ও বললো, বাঃ, তাতে কি হলো?
খুব সিরিয়াস হয়ে বললে, বাচ্চাদের নিয়ে ঐ গাড়িতে যাওয়ায় কত সুবিধা জান? হঠাৎ দরজা খুলে পড়ে যাবার কোন ভয় নেই, তা জান?
মেমসাহেবের কল্পনার বোয়িং সেভেন-জিরো-সেভেন তখন চল্লিশ হাজার ফুট উপরে উড়ছে। তাছাড়া প্ৰায় সাড়ে পাঁচশ-ছাঁ শো মাইল স্পীডে ছুটে চলেছিল। আমি সেই উড়ো জাহাজের কো-পাইলট হয়েও ওকে পালামের মাটিতে নামাতে পারলাম না। মনে মনে কষ্ট হলো। তাছাড়া আগামী দিনের ওর স্বপ্ন হয়ত আমারও ভাল লেগেছিল। মুখে শুধু বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।
দুপুর বেলা লাঞ্চের পর দুজনে শুয়ে শুয়ে আরো কত গল্প শুনলাম।…
ওগো, খোকনের খুব ইচ্ছা একবার তোমার কাছে আসে।
আমি বললাম, পাঠিয়ে দিও না।।
না, না, এখন না। আগে আমাদের সংসার হোক, তারপর আসবে।
আমি জানতে চাইলাম, আচ্ছা মেমসাহেব, তুমি খোকনকে খুব ভালবাস, তাই না?
মেমসাহেব বললে, কি করব বল? কাকাবাবুকে তো আমরা কোনদিনই ভাড়াটে ভাবি না। কাকিমা বেঁচে থাকলে হয়ত অতি–মেলামেশা ভাব হতো না। তাছাড়া কাকাবাবু অফিস আর টিউশনি নিয়ে প্রায় সারাদিনই বাড়ির বাইরে। তাই আমরা ছাড়া খোকনকে কে দেখবে বলো?
আমি বললাম, তাতো বুঝলাম। কিন্তু তুমি খোকনকে একটু বেশী ভালবাস।
পাশ ফিরে শুয়ে আমাকে আর একটু কাছে টেনে নিয়ে ও বললে, কেন তোমার হিংসা হয়?
আমি উত্তর দিলাম, আমার হিংসা হবে কেন?
আমিও একটু পাশ ফিরে শুলাম। বললাম, গতবার খোকন যখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিল, তখন তুমি কি কাণ্ডটাই না করলে?
করব না? আমরা ছাড়া ওর কে আছে বল?
আমরা, আমরা বলছি কেন? বল আমি ছাড়া কে করবে?
ও কোন উত্তর দিল না। শুধু হাসল। একটু পরে আমার মুখে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললে, আমি বাড়ির মধ্যে সব চাইতে ছোট। কেউ আমাকে দিদি বলে ডাকে না। ছোটবেলা–থেকেই আমার একটা ভাই এর শখ।….
তাই বুঝি?
কি যেন ভেবে ও হাসল। জিজ্ঞাসা করলাম, হাসছ কেন? ছোটবেলার একটা কথা মনে হলো। কি কথা?
মেমসাহেব। আবার হাসল। বললে, ছোটবেলায় একটা ভাই দেবার জন্য আমি মাকে খুব বিরক্ত করতাম।
আমি হাসলাম।
হাসতে হাসতেই ও বললে, সত্যি বলছি, অনেকদিন পৰ্যন্ত একটা ভাই দেবার জন্য মাকে বিরক্ত করেছি। আর আমি যেই ভাই এর কথা বলতাম সঙ্গে সঙ্গে দিদিরা চলে যেত। আর মা আমাকে বকুনি দিয়ে ভাগিয়ে দিতেন।
তাই বুঝি তুমি খোকনকে এত তালবাস?
অনেকটা তাই। তাছাড়া খোকন ছেলেটাও ভাল আর আমাকেও ভীষণ ভালবাসে।
সেকথা সত্যি।
ও চট করে আমার ঠোঁটে একটু ভালবাসার স্পর্শ দিয়ে বললো, থ্যাঙ্ক ইউ।
পরে আবার মেমসাহেব বলেছিল, সকাল বেলায় ধুতি পাঞ্জাবি পরে খোকন যখন কলেজে যায়, তখন আমার ভীষণ ভাল লাগে।
লাগবেই তো। নিজে হাতে নিজের স্নেহ দিয়ে যাকে এত বড় করেছ, সেই ছেলে বড় হলে, তাল হলে, নিশ্চয়ই ভাল লাগবে।
একটু থামি, একটু হাসি। ও জিজ্ঞাসা করল, আবার হাসছ কেন?
এমনি।
এমনি কেন?
আবার হাসলাম, আবার বললাম, এমনি।
মেমসাহেব পীড়াপীড়ি শুরু করে দিল। এমনি কেন হাসছ বল না।
হাসতে হাসতেই আমি বললাম, বলব?
বলো।
আবার হাসলাম। বললাম, সত্যি বলব?
মেমসাহেব কনুই এর ভর দিয়ে আমার মুখের ওপর হুমডি খেয়ে বললে, বলছি তো বল না।
দু’হাত দিয়ে ওর মুখটা টেনে নিয়ে কানে কানে জিজ্ঞাসা করলাম, আমাদের খোকন কবে হবে?
মেমসাহেবও আমার কানে কানে বললে, তুমি যেদিন চাইবে?
সিওর?
সিওর।
ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বললাম, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরী মাছ।
ও হাসতে হাসতে উত্তর দিল, নট অ্যাট অল! ইট ইউল বী মাই প্লেজার।
আর ইউ সিওর ম্যাডাম?
ইয়েস স্যার, আই এ্যাম সিওর।
এই কথার পর দুজনেরই যেন কি হলো। কি যেন সব দুষ্টুমি বুদ্ধির ঝড় উঠল। দুজনেরই মাথায়। সেদিন দুপুরে ঐ শান্ত স্নিগ্ধ মেমসাহেব যে কি কাণ্ডটাই করল। পরে আমি বলেছিলাম, জান মেমসাহেব, তোমাকে দেখে বুঝা যায় না তোমার মধ্যে এত দুষ্টুমি বুদ্ধি লুকিয়ে আছে।
ও পাশ ফিরে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে বললে, বাজে বকো না।
পরের দিন ভোরবেলায় এলাম সিলিসের। লেকের ধারে পাহাড়ের পর এককালের রাজপ্ৰাসাদ এখন সরকারী পান্থশালা। দোতলার ম্যানেজারের খাতায় নাম ধাম লিখে ঘরের চাবি নিয়ে তিন-তলার ছাদে এসে দাঁড়াতেই মেমসাহেব লেক আর পাহাড় দেখে মুগ্ধ হলো। বললো, চমৎকার।
মাথায় ঘোমটা, কপালে বিরাট সিদুরের টিপ, চোখে সানগ্লাস দিয়ে মেমসাহেবকে এই পরিবেশে আমার যেন আরো হাজার হাজার গুণ ভাল লাগল। আমি বললাম, সত্যি চমৎকার।
তা আমার দিকে তাকিয়ে বলছি কেন?
এই লেক, পাহাড় আর এই রাজপ্রাসাদের চাইতেও তোমাকে বেশী ভাল লাগছে।
আমার প্রশংসা গ্ৰাহ না করে ও ছাদের চারপাশ ঘুরে ঘুরে লোক আর পাহাড় দেখছিল। ইতিমধ্যে ছাদের ওপাশ থেকে অকস্মাৎ এক সদ্য বিবাহিতা মহিলা মেমসাহেবের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা বাঙালী?