আমি চুপ করেছিলাম। রাত্রে আমেদাবাদ মেল ধরে পরদিন ভােরবেলায় জয়পুর পৌঁছলাম।
ট্ৰেনে?
ট্রেনের কথা কি লিখব? সেকেণ্ড ক্লাসে গিয়েছিলাম। কম্পার্টমেন্টে আরো প্যাসেঞ্জার ছিলেন। অনেক কিছুই তো ইচ্ছা করেছিল। কিন্তু…। তবে দুজনে এক কোণায় বসে অনেক রাত পৰ্যন্ত গল্প করেছিলাম। মেমসাহেবকে শুতে বলেছিলাম। কিন্তু রাজী হয় নি। ও বলেছিল, তুমি শোও। আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
না, না, তা হয় না।
কেন হবে না?
তুমি জেগে থাকবে। আর আমি ঘুমাব?
আগে তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও। পরে আমি ঘুমাব।
আমার ঘুমুতে ইচ্ছা করছিল না। তাই বললাম, তাছাড়া এইটুকু জায়গায় কি ঘুমান যায়?
এইত আমি সরে বসছি। তুমি আমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়া।
আমার হাসি পেল।
হাসছ কেন?
হাসতে হাসতেই আমি জবাব দিলাম, রেলের এই কম্পার্টমেন্টেও কি তুমি আমাকে আদর করবে?
ও রেগে গেল। বেশ করব। একশবার করব। আমি কি পরপুরুষকে আদর করছি?
মেমসাহেব একটু সরে বসল। আমি ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম।
ও আমার মাথায় মুখে হাত দিয়ে আদর করে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা শুরু করল। কয়েক মিনিট বাদে মুখটা আমার মুখের পর এনে জিজ্ঞাসা করল, কি ঘুমুচ্ছ?
ঘুমুবে না?
কেন?
এত সুখে, এত আনন্দে ঘুম আসে না।
এবার মেমসাহেব হাসল। জিজ্ঞাসা করল, সত্যি ভাল লাগছে?
খুব ভাল লাগছে।
ও চুপ করে যায়। কিছু পরে ও আবার হুমঢ়ি খেয়ে আমার মুখের পর পড়ল। বললে, একটা কথা বলব?
বল।
তুমি রোজ এমনি করে আমার কোলের পর মাথা রেখে শোবে, আর আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেব।
কেন?
কেন আবার? আমার ইচ্ছা করে, ভাল লাগে।।
আমি কোন উত্তর দিলাম না। ওর কোলের মধ্যে মুখ গুঁজে দিয়ে হাসছিলাম।
মেমসাহেব দু’হাত দিয়ে আমার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললো, হাসছ কেন?
এমনি।
না, তুমি অমন করে হাসবে না!
বেশ।
মেমসাহেব। আবার আমার মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আমার ভীষণ ভাল লাগছিল যে সত্যি সত্যিই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
ঘুম ভেঙেছিল একেবারে তোরবেলায়। ঘড়িতে দেখলাম সাড়ে চারটে। মেমসাহেবও ঘুমুচ্ছিল। দুহাতে আমার মুখটা জড়িয়ে ধরে মাথাটা হেলান দিয়ে বসে বসেই ঘুমুচ্ছিল। ভীষণ লজ্জা, ভীষণ কষ্ট লাগল। আমি উঠে বসতেই ওর ঘুম ভেঙে গেল। আমি কিছু বলবার আগেই ও জিজ্ঞাসা করল, উঠলে যে?
আমি ওর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কটা বাজে জান?
কটা?
সাড়ে চারটে।
তাই বুঝি।
তুমি সারা রাত্রি এইভাবে বসে বসেই কাটালে?
ঐ আবছা আলোতেই আমি দেখতে পেলাম একটু হাসিতে মেমসাহেবের মুখটা উজ্জল হয়েছিল। বললে, তাতে কি হলো।
আমি রেগে বললাম, তাতে কি হলো? সারা রাত্রি আমি মজা করে শুয়ে রইলাম আর তুমি বসে বসে কাটিয়ে দিলে?
শান্ত স্নিগ্ধ মেমসাহেব আমার মুখে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললে, রাগ করছ, কেন? বিশ্বাস কর, আমার একটুও কষ্ট হয় নি।
আমি উপহাস করে বললাম, না, না, কষ্ট হবে কেন? বড্ড আরামে ঘুমিয়েছি।
আবার সেই মিষ্টি হাসি, স্নিগ্ধ শান্ত কণ্ঠ। আরাম না হলেও আনন্দ তো পেয়েছি।
জান দোলাবৌদি, পোড়াকপালী এমনি করে ভালবেসে আমার সর্বনাশ করেছে।
জয়পুরে গিয়ে কি করেছিল জান? হোটেলে গিয়ে স্নান করে ব্রেকফাস্ট খাবার পর আমি বললাম, কাপড়-চোপড় পালটে নাও।
কেন?
কেন আবার? ঘুরতে বেরুবা।
কোথায় আবার ঘুরবে?
জয়পুর এসে সবাই যেখানে ঘুরতে যায়।
ও বললে, আমি তো অম্বর প্যালেস বা হাওয়া মহল দেখতে আসিনি।
তবে জয়পুর এলে কেন?
কেন আবার? তোমাকে নিয়ে বেড়াতে এলাম। এতদিন ধরে পরিশ্রম করছি। তাই একটু বিশ্রাম পাবে বলে জয়পুর এলাম।
আমি বললাম, দিল্লীতেই তো বিশ্রাম করতে পারতাম।
ভাবলাম আমার সঙ্গে একটু বাইরে গেলে আরো ভাল লাগবে, তাই এলাম।
লনের এক কোণায় একটা গাছের ছায়ায় বসে বসে। সারা সকাল কাটিয়ে দিলাম। আমরা।
ওগো তুমি যখন গাড়ি কিনবে তখন প্ৰত্যেক উইক-এণ্ডে আমরা বাইরে বেরুব। কেমন?
আঙুল দিয়ে নিজের দিকে দেখিয়ে বললাম, আমি গাড়ি কিনব?
তবে কি আমি কিনব?
তুমি কি পাগল হয়েছ?
কেন তুমি বুঝি গাড়ি কিনবে না?
দূর পাগল। আমি গাড়ি কেনার টাকা পাব কোথায়?
ও যেন সত্যি একটু রেগে গেল। তুমি কথায় কথায়, আমায় পাগল পাগল বলবে না তো।
পাগলের মত কথা বললেও পাগল বলব না?
ভ্রূ কুঁচকে ও প্ৰায় চীৎকার করে বললে, না।
একটু পরে আবার বললে, গাড়ি কেনবার কথা বলায় পাগলামি কি হলো?
আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে ওর মুখে ধুঁয়া ছেড়ে বললাম, কিচ্ছু না।
আশ্চৰ্য আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ও বললে, দেখ না এক বছরের মধ্যে তোমার গাড়ি হবে।
তুমি জান?
একশ বার জানি।
একটু পরে আবার কি বললো জান? মেমসাহেব আমার গা ঘোষে বসে আমার কাঁধের ’পর মাথা রেখে আধো-আধো স্বরে বললে, ওগো, তুমি আমাকে ড্রাইভিং শিখিয়ে দেবে?
ও তখন বোয়িং সেভেন-জিরো-সেভেনের চাইতেও অনেক বেশী গতিতে উপরে উঠছিল। সুতরাং আমি অযথা বাধা দেবার ব্যর্থ চেষ্টা না করে বললাম, নিশ্চয়ই।
মনে মনে আমার হাসি পাচ্ছিল। কিন্তু অনেক চেষ্টায় সে হাসি চেপে রেখে বেশ স্বাভাবিক হয়ে জানতে চাইলাম, কি গাড়ি কিনতে চাও?
আমার প্রশ্নে ও খুব খুশি হলো। হাসিতে মুখটা ভরে গেল। টান টানা চোখ দু’টো যেন আরো বড় হলো। বললে, তোমার কোন গাড়ি পছন্দ?
ওকে সন্তুষ্ট করবার জন্য বললাম, গাড়ি কিনলে তো তোমার পছন্দ মতই কিনব।