আবার অসভ্যতা?
আমি বাথরুম থেকে বেরুতে বেরুতেই মেমসাহেব আমার ব্রেকফাস্ট নিয়ে আসে। আমি বলি, কি আশ্চৰ্য! একটা বেয়ারাকে বলতে পারলে না?
আজ্ঞে বেয়ারারা আপনার চাকর নয়। ন’টার পর ওরা ব্রেকফাস্ট সার্ভ করে না।
তাই বলে তুমি? যারা দেখল, তারা কি ভাবল বল তো?
ট্রে-টা নামিয়ে রেখে টোস্টে মাখন মাখাতে মাখাতে বলল, ভাবল আমার কপালে একটা অপদাৰ্থ কুঁড়ে জুটেছে।
বল দোলাবৌদি, এ কথার কি জবাব দেব? আমি জবাব দিতাম না। চুপটি করে ব্রেকফাস্ট খেয়ে নিতাম।
তারপর বারান্দায় দু’টো সোফায় বসে আমরা গল্প করতাম কিছুক্ষণ। কিছুক্ষণের জন্য একটু ঘুরে ফিরেও আসতাম। দুপুরবেলায় লাঞ্চ খাবার পর মেমসাহেব জিজ্ঞাসা করত, এখন একটু ঘুমোও।
কেন আজকে কি রাত্ৰি জাগবে?
আবার সেই গালে একটা চড়। আবার সেই মন্তব্য, অসভ্য কোথাকার।
দুপুরে ঘুমুতাম না। শুয়ে থাকতাম। আমার হাতটা ভুল করে একটু অবাধ্যতা করলে মেমসাহেব বলত, দয়া করে তোমার। হাতটাকে একটু সংযত কর।
কেন? আমি কি না বলিয়া পরের দ্রব্যে হাত দিতেছি?
পরের দ্রব্য না হইলেও আমি এখনও আপনার দ্রব্য হই নাই বলিয়া আপনি হাত দিবেন না। =
আমি চট করে উঠে পড়ে গায় জামাটা চাপিয়ে বেরুতে যাই। মেমসাহেব জানতে চায়, কোথায় যাচ্ছ?
বাজারে। কেন? মালা কিনতে, টোপর কিনতে।
মেমসাহেব হাসতে হাসতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, তাই বলে এই দুপুরে যেও না।
ও আমাকে টেনে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয়। আমার পাশে কাত হয়ে শুয়ে শুয়ে বলে, এখনই যদি আমার জন্য এত পাগলামি কর, তবে ভবিষ্যতে কি করবে?
দেখ মেমসাহেব, রেশনের হিসাব মত চাল-গম বিক্ৰী করা চলতে পারে। কিন্তু ভালবাসা চলতে পারে না।
আমার কথা শুনে ও মুচকি মুচকি হাসে।
জান দোলাবৌদি, সমাজ-সংসার থেকে কটি দিনের জন্য আমরা দূরে চলে গিয়েছিলাম। ইচ্ছা করলে মুক্ত বিহঙ্গের মত সম্ভোগের মহাকাশে আমরা উড়ে বেড়াতে পারতাম। কিন্তু তা করিনি। মেমসাহেবকে অত কাছে পেয়ে, নিবিড় করে পেয়ে, স্বাধীনভাবে পেয়ে মাঝে মাঝে আমার চিত্ত চঞ্চল হয়েছে, শিরার মধ্যে দিয়ে উত্তেজনার বন্যা বয়ে গেছে, ন্যায়-অন্যায়ের সূক্ষ্ম বিচার-বুদ্ধি কখনও কখনও হারিয়ে গেছে কিন্তু তবুও শান্ত-স্নিন্ধ ভালবাসার ছোয়ায় মেমসাহেব আমাকে সংযত করে রেখেছে। প্রথম, কদিন ওকে কাছে পাবার সময় ওর এই সংযম, সংযত আচরণ আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আমি হয়ত ওকে শ্রদ্ধাও করতে আরম্ভ করেছিলাম।
ভবিষ্যতের জন্য আমরা অনেক কিছু গচ্ছিত রাখলেও এই কটি দিনে অনেক কিছু পেয়েছিলাম। দেহের ক্ষুধা মিটাইনি। কিন্তু চোখের তৃষ্ণা, প্ৰাণের হাহাকার, মনের দৈন্য দূর হয়েছিল। আর? আর দূর হয়েছিল চিত্ত-চাঞ্চল্য ও মানসিক অস্থিরতা। আমার চোখের সামনে একটা সুন্দর শান্ত ভবিষ্যৎ জীবনের ছবি ফুটে উঠেছিল।
আর মেমসাহেব? আমার অনেক দুর্বলতার মধ্যেও মেমসাহেব আমার ভালবাসার গভীরতা উপলব্ধি করেছিল। অন্ধের যষ্টির মত আমার জীবনে তার অনন্য গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাও নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিল। শিক্ষিতাই হোক আর সুন্দরীই হোক, গরীব হোক বা ধনী হোক, মেয়েদের জীবনে এর চাইতে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে?
তাইতো হাসি, খেলা, গান ও রাত্ৰি জাগরণের মধ্য দিয়েও আমরা ভবিষ্যতের রাস্তা ঠিক করে নিয়েছিলাম। দুজনে মিলে প্ৰতিজ্ঞা করেছিলাম। শুধু কিছু হাসি আর খেলা করে জীবনটাকে নষ্ট করব না।
কলকাতা ফেরার আগের দিন রাত্ৰিতে মেমসাহেব সেই আমার দেওয়া শাড়ীটা পরেছিল। তারপর মাথায় কাপড় দিয়ে গলায় আঁচল জড়িয়ে আমাকে প্ৰণাম করেছিল। সেদিন আমার জীবনউৎসবের পরম মুহুর্তে কোন পুরোহিত মন্ত্র পড়েন নি, কোন কুলবধু শাখ বাজান নি, আত্মীয়-বন্ধু সাক্ষী রেখে মালা বদল করিনি। কিন্তু তবুও আমরা দুজনে জেনেছিলাম আমাদের দুটি জীবনের গ্ৰন্থিতে অচ্ছেদ্য বন্ধন পড়ল।
০৯. তোমার চিঠি পেয়েছি
তোমার চিঠি পেয়েছি। একবার নয়, অনেকবার পড়েছি। তুমি হয়ত আমার মনের খবর ঠিকই পেয়েছ। কিন্তু আমার মনে অনেক দুঃখ থাকলেও আক্ষেপ নেই, বেদন থাকলেও ব্যর্থতার গ্লানি নেই। তার দীর্ঘ কারণ আজ বলব না, হয়ত তুমিও বুঝবে না। আমার এই কাহিনী যখন লেখা শেষ হবে, সেদিন আশা করি সবকিছু দিনের আলোর মত স্পষ্ট হবে।
তবে হ্যাঁ, আজ এইটুকু জেনে রাখা আমি জীবনে যে প্ৰেমভালবাসার ঐশ্বৰ্য পেয়েছি, তার তুলনা হয় না। হয়ত আরো অনেকে এই ঐশ্বৰ্য পেয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে আমার ঐশ্বর্যের কোন তুলনা করার মাপকাঠি আমার জানা নেই, প্রয়োজনও নেই। তবে এইটুকু নিশ্চয়ই জানি আমি পূর্ণ পরিপূর্ণ হয়েছি। আর জানি আমার এই ঐশ্বর্যের সঙ্গে পৃথিবীর কোন ধনীর কোন ঐশ্বর্ষের তুলনা হয় না। ধনী একদিন সমস্ত কিছু হারিয়ে দরিদ্র, তিখারী হতে পারে, সে ঐশ্বর্ষের হস্তান্তর হতে পারে, অপব্যয়, অপব্যবহার হতে পারে। কিন্তু আমার প্রাণ-মনের এই অতুলনীয় সম্পদ কোনদিন হারাবে না, হারাতে পারে না। যতদিন আমি এই পৃথিবীতে থাকিব, ততদিন ঐ ঘন কালো টান টানা গভীর দুটি চোখ আমার জীবন-আকাশে ধ্রুবতারার মত উজ্জল ভাস্বর হয়ে থাকবে। এই পৃথিবীর পঞ্চভূতের মাটিতে একদিন আমি মিশে যাব, আমার সমস্ত খেলা একদিন স্তব্ধ হয়ে যাবে, সবার কাছ থেকে আমি চিরতরে হারিয়ে যাব, কিন্তু আমার মেমসাহেব কোনদিন হারিয়ে যাবে না। আমার এই চিঠিগুলি যতদিন থাকবে, মেমসাহেবও ততদিন থাকবে। তারপর সে রইবে তোমার ও আরো অনেক অনেকের স্মৃতিতে। তারপরও ভারতবর্ষের অনেক শহরেনগরে গ্রামে গেলে মেমসাহেবের স্মৃতির স্পৰ্শ পাওয়া যাবে। উত্তর বঙ্গের বনানীতে, বোম্বাইএর সমুদ্রসৈকতে, বরফে-ঢাকা গুলমার্গের আশেপাশে নিস্তব্ধ রাত্ৰে কান পাতালে হয়ত মেমসাহেবের গান আরো অনেকদিন শোনা যাবে।