মেমসাহেব হঠাৎ মাথাটা ছাড়িয়ে নিয়ে দু’হাত দিয়ে আমাকে চেপে ধরে বলল, ভগবান কি করবেন, তা ভগবানই জানেন কিন্তু তুমি কি আমাকে সুখী করবে?
কি মনে হয়?
মনে মনে তো ভয়ই হয়।
কিসের ভয়?
কানে কানে ফিস ফিস করে মেমসাহেব বলল, হাজার হোক খবরের কাগজের রিপোর্টার! কবে, কখন, কোথায় হয়ত কোন সুন্দরী এসে তোমাকে ঝড়ের বেগে উড়িয়ে নিয়ে যাবে…।
তাই নাকি?
তবে আবার কি! পুরুষদের বিশ্বাস নেই…!
জান মেমসাহেব, তোমাকে নিয়ে আমারও অনেক ভয়।
আমার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে আঙুল দিয়ে নিজেকে দেখিয়ে মেমসাহেব অবাক হয়ে বলল, আমাকে নিয়ে তোমার ভয়?
জি, মেমসাহাব।
বাজে বাকো না।
বাজে না মেমসাহেব। জীবনে সুপ্ৰতিষ্ঠিত কোন মানুষের আমন্ত্রণ এলে পঞ্চাশ টাকার এই রিপোর্টারকে নিশ্চয়ই তোমার ভুলে যেতে কষ্ট হবে না।
দপ করে জ্বলে উঠল মেমসাহেব, সব সময় তুমি পঞ্চাশ টাকার রিপোর্টার, পঞ্চাশ টাকার রিপোর্টার বলবে না তো! সারা জীবনই কি তুমি পঞ্চাশ টাকার রিপোর্টার থাকবে?
থাকব না!
না, না, না।
তাহলে কি হবে?
কি আবার হবে? জীবনে মানুষ হবে, বড় হবে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।
পারব?
একশবার পারবে। তাছাড়া আমি আছি না।
মেমসাহেব আমাকে একটু কাছে টেনে নেয়। একটু আদর করে। মাথার চুলগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে। আবার বলে, তুমি ভাব কেন যে তুমি হেরে গেছ?
কি করব বল মেমসাহেব? অকুল সমুদ্রে জাহাজ ভেসে বেড়ায়, কিন্তু লাইট হাউসের ঐ ছোট্ট একটা আলোর ইঙ্গিত না পেলে তো সে বন্দরে ভিড়তে পারে না।
আমি তো এসেছি, আর ভয় কি? কিন্তু কথা দিতে পার আমার বন্দর ছেড়ে তুমি তোমার জাহাজ নিয়ে অন্য বন্দরে বন্দরে ঘুরে বেড়ায় না?
আচ্ছা দোলাবৌদি, সব মেয়েদের মনেই ঐ এক ভয়, এক সন্দেহ কেন বলতে পার? পৃথিবীর ইতিহাস কি শুধু পুরুষদের বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনীতেই ভরা? যাই হোক মেমসাহেবের কথা আমার বেশ লাগত। অন্তত এই ভেবে আমি তৃপ্তি পেতাম যে সে আমাকে সম্পূর্ণভাবে কামনা করে।
সেদিন কথায় কথায় সন্ধ্যা নেমে এলো। মন্দিরের মঙ্গলদীপের আলোর প্রতিবিম্ব পড়ল। গঙ্গায়। স্রোতস্বিনী গঙ্গা সে আলো ভাসিয়ে নিয়ে গেল দূর-দূরান্তরে, শহরে, নগরে, জনপদে আর অসংখ্য মানুষের মনের অন্ধকার গহন অরণ্যে।
মেমসাহেব শেষকালে প্রশ্ন করল, কই তুমি তো জানতে চাইলে না তোমাকে আজ এখানে নিয়ে এলাম কেন? তুমি তো জানতে চাইলোচনা তোমাকে প্ৰণাম করে আশীৰ্বাদ চাইলাম কেন?
কোন বিশেষ কারণ আছে নাকি? তবে কি, এই বলে মেমসাহেব ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে আমাকে পড়তে দিল।
পড়ে দেখি হাওড়া গার্লস কলেজের অ্যাপিয়েণ্টমেণ্ট লেটার। মেমসাহেবের দুটি হাত ধরে বললাম, কনগ্ৰাচুলেশনস। এইত অয়মারম্ভ, আনন্দে ঐশ্বৰ্যে ভগবান নিশ্চয়ই তোমাকে ভরিয়ে তুলবেন।
একটু থেমে প্রশ্ন করি, মাসে মাসে আড়াইশ টাকা দিয়ে কি করবে। মেমসাহেব?
কেন? দুজনে মিলেও ওড়াতে পারব না?
দুজনেই হেসে উঠি।
মেমসাহেব অধ্যাপনা করা শুরু করায় গৰ্বে আমার বুকটা ভরে উঠল। কদিন পরে অফিস থেকে পাঁচিশটা টাকা অ্যাডভান্স নিলাম। চিত্তরঞ্জন এভিন্নুর সেলস এম্পোরিয়াম থেকে আঠারো টাকা দিয়ে একটা তীতের শাড়ী। কিনলাম। বিকেল বেলায় মেমসাহেবকে প্যাকেটটা দিয়ে বললাম, এই শাড়ীটা পরে কালকে কলেজে যেও।
পরের দিন ঐ শাড়ীটা পরে কলেজে গিয়েছিল, কিন্তু তারপর আর পরত না। একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, শাড়ীটা বুঝি তোমার পছন্দ হয় নি?
খুব পছন্দ হয়েছে।
সেইজন্যই বুঝি পরতে লজ্জা করে?
কানে কানে বলল, না, গো, না। ওটা তোমার প্রথম প্ৰেজেনটেশন। যখন তখন পড়ে নষ্ট করব নাকি?
প্ৰথম মাসে মাইনে পাবার পর মেমসাহেব আমাকে কি দিয়েছিল জান? একটা গারদের পাঞ্জাবি আর একটা চমৎ তাঁতের ধুতি।
ধুতিটা কেনার সময় ভারী মজা হয়েছিল।
মেমসাহেব জিজ্ঞাসা করল, জরিপাড় নেবে? নাকি প্লেন পাড় নেবে?
দোকানের আর কেউ শুনতে না পারে। তাই কানে কানে বললাম, যদি টোপরটাও কিনে দাও তাহলে জরিপাড় ধুতি কেন; আর যদি এখন টোপর না কিনতে চাও তবে প্লেন পাড়ই…।
অসভ্য কোথাকার।
ধুতি কিনে দোকান থেকে বেরুতে বেরুতে মেমসাহেব বলল, তুমি ভারী অসভ্য।
কি আশ্চর্য! তোমার সঙ্গেও ফ্রাঙ্কলি কথা বলব না?
এই তোমার ফ্রাঙ্কলি বলার ঢং?
সেসব দিনের কথা আজ তোমাকে লিখতে বসে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। কি কারণে ও কেমন করে আমরা দুজনে এত দ্রুততালে এগিয়ে চলেছিলাম, তা আমি জানি না। কোন যুক্তিতর্ক দিয়ে এসব বোঝান সম্ভব নয়। মানুষের মন লজিকের প্রফেসর বা বিচারকদের পরামর্শ বা উপদেশ মেনে চলে না। মুক্ত বিহঙ্গের মত সে আপন গতিতে উড়ে বেড়ায়, ঘুরে বেড়ায়। মানুষের মন যদি বিচার-বিবেচনা মেনে চলতে জানত তাহলে শুধু আমার বা মেমসাহেবের কাহিনী নয়, পৃথিবীর ইতিহাসও একেবারে অন্যরকম হতো।
মাতৃগৰ্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হবার পর থেকেই মানুষ এক’জনকে অবলম্বন করে বড় হয়, ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে চলে। একটি মুখের হাসি, দুটি চোখের জলের জন্য মানুষ কত কি করে! আমি বড় হয়েছি, ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে গেছি নিতান্তই প্রকৃতির নিয়মে। মায়ের মুখের হাসি বা প্রিয়জনের চোখের জলের কোন ভূমিকা ছিল না আমার জীবনে। তাইতো আমি মেমসাহেবকে সমস্ত মন, প্ৰাণ, সত্তা দিয়ে চেয়েছিলাম। এই চাওয়ার মধ্যে একটুও ফাঁকি ছিল না। তাইতো মেমসাহেবকেও পাওয়ার মধ্যেও কোন ফাঁকি থাকতে পারে নি। স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির বাইশটি বসন্ত অতিক্রম করতে মেমসাহেবের জীবনে নিশ্চয়ই কিছু কিছু মাছি বা মৌমাছি তিনভন করেছে চারপাশে। হয়ত বা কারুর গুজন মনে একটু রং লাগিয়েছে কিন্তু ঠিক আমার মত কেউ সমস্ত জীবনের দাবী নিয়ে এগিয়ে আসতে পারে নি। তাইতো মেমসাহেবের জীবনের সব বাঁধন খুলে গিয়েছিল, সংযম আর সংস্কার ভেসে গিয়েছিল।