কোনদিন নিজেদের বাড়ি থেকে কোনদিন আবার ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরী থেকে মেমসাহেব আমার জন্য বই আনা শুরু করল। আমিও ধীরে ধীরে পড়াশুনা শুরু করলাম। ইংরেজি-বাংলা দুইই পড়লাম। বিদ্যাসাগর, হেমচন্দ্ৰ, নবীনচন্দ্ৰ, মাইকেল আবার পড়লাম। রমেশচন্দ্ৰ, শিবনাথ শাস্ত্রী প্ৰভৃতিও বাদ পড়লেন না। তারপর মোহিতলাল থেকে জীবানন্দও মেমসাহেব প্রেসক্রিপশন করল। ওদিকে ডরোখী পার্কারকে পড়লাম, পড়লাম রবার্ট ফ্রস্ট-টি এস ইলিয়ট-এজরা পাউণ্ডের কবিতা। আমার মন ছটফট করে ওঠে। মেমসাহেবকে বললাম, ‘মেমসাহেব, এবার তোমার পাঠশালা বন্ধ কর।
মেমসাহেব কি বলল জান? বলল, বাজে বকো না। কিছু লেখাপড়া না করে জার্নালিজম করতে তোমার লজা করে না? লজ্জা? জার্নালিস্টদের লজ্জা! তুমি হাসালে মেমসাহেব। মেমসাহেবের দাবিড় খেয়ে হাক্সলে, হেনরি গ্রীন, হেমিংওয়ে, লরেন্স ডুরেল, অ্যানি পটার, মেরী ম্যাকার্থির এক গাদা বই পড়লাম।
এর পর একদিন আমাকে গীতবিতান প্ৰেজেণ্ট করল। আমি অবাক হয়ে গেলাম। ভাবলাম, মেমসাহেব কি এবার আমাকে গানের স্কুলে ভর্তি করবে? জিজ্ঞাসা করলাম, তানপুরা পাব না?
মেমসাহেব রেগে গেল। আমার মুণ্ডু পাবে।
পরে বলেছিল, যখন হাতে কাজ থাকবে না, চুপচাপ গীতবিতানের পাতা উল্টিয়ে যেও। খুব ভাল লাগবে। দেখবে তুমি অনেক কিছু ভাবতে পারছি, কল্পনা করতে পারছ।
ইতিমধ্যে এম. এ. পাশ করে মেমসাহেব একটা গার্লস কলেজে অস্থায়ীভাবে অধ্যাপনা শুরু করে দিয়েছে। ইতিমধ্যে আরো অনেক কিছু হয়ে গেছে। মেমসাহেব উপলব্ধি করল আমার অন্তরের শূন্যতা, জীবনের ব্যর্থতা, ভবিষ্যতের আশঙ্কা। উপলব্ধি করল আমার জীবন-যজ্ঞে তাঁর অনন্য প্ৰয়োজনীয়তা। আমি নিজেই একদিন বললাম, জান মেমসাহেব, প্ৰথমে শুধু বাঁচতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরে এক দুর্বল মুহুর্তে স্বপ্ন দেখলাম আমি এগিয়ে চলেছি। দশজনের মধ্যে এক’জন হবার স্বপ্ন দেখলাম। সেই স্বপ্নের ঘোরে বেশ কিছুকাল কেটে গেল। যখন সম্বিত ফিরে পেলাম, তখন নিজের দুরবস্থা দেখে নিজেই চমকে গেলাম, ঘাবড়ে গেলাম, হতাশ হলাম।
একটু থামি।
আবার বলি, সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষার, স্বপ্ন-সাধনা বিসর্জন দিয়ে নিজেকে তুলে দিলাম। অদৃষ্টের হাতে। কিন্তু তোমাকে দেখে আমার সব হিসাব-নিকাশ ওলট-পালট হয়ে গেল। মুহুর্তের মধ্যে আবার সমস্ত স্বপ্ন উড়ে এসে জড়ো হলো মনের আকাশে।
মেমসাহেবের হাতটা চেপে ধরে বললাম, ভগবানের নামে শপথ করে বলছি, মেমসাহেব। তোমাকে দেখেই যেন মনে হলো তুমি তো আমারই। এই অন্ধকূপ থেকে আমাকে মুক্তি দেবার জন্যই যেন ভগবান তোমাকে পাঠিয়েছেন।
আমার মত মেমসাহেব কোনদিনই বেশী কথা বলত না। শুধু বলল, হয়ত তাই। তা না হলে তোমার সঙ্গে। অমন অপ্রত্যাশিতভাবে পরের দিনই আবার দেখা হবে কেন?
অদৃষ্টর ইঙ্গিত, নিয়তির নির্দেশ মেমসাহেবও বুঝতে পেরেছিল। আমি অনেক কথা বলার পরই দু’হাত তুলে মেমসাহেবের কাছে আত্মসমৰ্পণ করেছিলাম। মেমসাহেবের অনুষ্ঠান অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়েছিল।
প্রতিদিনের মত সেদিন বেলা দেড়টা-দু’টোর সময় অফিস গিয়েছিলাম। টেলিপ্ৰিণ্টারের কয়েকটা লোক্যাল কপি দেখতে দেখতেই টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলে অভ্যাস মত বললাম, রিপোর্টার্স।
কখন অফিসে এলে?
এইত একটু আগে।
একটা কথা বলব?
বলো।
শুনবে?
নিশ্চয়ই।
চলো না একটু বেড়িয়ে আসি।
আমি একটু অবাক হয়ে জানতে চাই, এখন?
হ্যাঁ।
কি ব্যাপার বল তো।
বল না যাবে কিনা?
চীফ রিপোর্টার বা নিউজ এডিটর। তখনও অফিসে আসেন নি। কি করব, ভাবছিলাম। মেমসাহেব টেলিফোন ধরে থাকল। আমি ডায়েরীতে দেখে নিলাম দু’টো প্রেস কনফারেন্স ছাড়া আর কিছু নেই। একটা চারটের সময় আর দ্বিতীয়টা সন্ধ্যা সাতটায়।
মেমসাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, সাতটার মধ্যে ফিরতে পারব?
সাতটা? বোধহয় না।
কখন ফিরবে?
আটটা-সাড়ে আটটার মধ্যে নিশ্চয়ই ফিরব।
চীফ রিপোর্টারকে একটা শ্লিপ লিখে রেখে গেলাম, একটা জরুরী নিউজের লোভে বেরিয়ে যাচ্ছি। রাত্রে ফিরে টেলিফোন ডিউটি!
অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লাম। এসপ্ল্যানেডের মোড়ে দুজনে মীট করে সোজা চলে গেলাম দক্ষিণেশ্বর। মন্দিরের দরজা বন্ধ ছিল। তাই এদিক-ওদিক ঘুরে পঞ্চবটী ছাড়িয়ে আরো খানিকটা দক্ষিণে গঙ্গার ধারে একটা গাছের ছায়ায় বসলাম দুজনে।
মেমসাহেব বলল, চোখ বন্ধ করা।
কেন?
আঃ। সব সময় কেন কেন করো না। বলছি চোখ বন্ধ কর।
পুরোটা না অর্ধেকটা বন্ধ করব? তুমি বড্ড তর্ক কর। মেমসাহেব এবার কড়া হুকুম দেয়, আই সে, ক্লোজ ইওর আইজ।
সত্যি সত্যিই চোখ বন্ধ করলাম। মুহুর্তের মধ্যে অনুভব করলাম মেমসাহেব আমার দুটি পায় হাত দিয়ে প্ৰণাম করছে। চমকে গিয়ে চোখ খুলে প্রশ্ন করলাম, একি ব্যাপার?
দেখি মেমসাহেবের মুখে অনিৰ্বাণ আনন্দের বন্যা, দুটি চোখে পরম তৃপ্তির দীপশিখা জ্বলছে। দুটি হাত দিয়ে মেমসাহেবের মুখটা তুলে ধরে আবার প্রশ্ন করলাম, হঠাৎ প্ৰণাম করলে কেন মেমসাহেব?
কোন উত্তর দিল না মেমসাহেব। আত্মসমর্পণের ভাষায় চাইল আমার দিকে। আমিও ওর দিকে চেয়ে রইলাম। অনেকক্ষণ। তারপর আবার জানতে চাইলাম, বল না প্ৰণাম করলে কেন?
এবার মেমসাহেব কথা বলে, আমি তোমাকে প্ৰণাম করলাম, তুমি আমাকে আশীৰ্বাদ করবে না?
আমি অবাক হয়ে যাই। নিজের দৈন্য এত স্পষ্ট হলো যে নিজেকে বেশ ছোট মনে হলো। মেমসাহেব প্ৰণাম করার পর কৈফিয়ত তলব না করে আমার আশীৰ্বাদ কয়া প্ৰথম কাজ ছিল। যাই হোক তাড়াতাড়ি মেমসাহেবকে কাছে টেনে নিলাম। দুটি হাত দিয়ে ওর মুখখান তুলে ধরে বললাম, ভগবান যেন তোমাকে সুখী করেন।