দুজনেয় দৃষ্টিই চারপাশ ঘুরে যায়। আমি আবার চুরি করে। মেমসাহেবকে দেখে নিই। ধরা পড়লাম না। কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারলাম না, ধরা পড়ে গেলাম।
একটু হাসতে হাসতে মেমসাহেব। আবার জানতে চায়, অমন করে কি দেখছেন?
আমি কয়েকবার আজেবাজে অপ্ৰয়োজনীয় কথা বলে ওর প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করলাম, পারলাম না।
আমি বললাম, আপনি জানেন না। আমি কি দেখছি?
না।
সত্যি?
মেমসাহেব। আবার হাসে। বলে, প্ৰথম দিনেই কিভাবে বুঝলেন আমি মিথ্যে কথা বলি।
না, তা ঠিক না।
তবে বলুন কি দেখছেন। মেমসাহেব যেন দাবী জানাল।
আমি আর দেরি করি না। মেমসাহেবকে দেখতে দেখতেই বললাম, আপনার চোখ দুটি বড় সুন্দর-
ঠোঁটটা কামড়াতে কামড়াতে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। মেমসাহেব। একটু নীচু গলায় বলল, ঘোড়ার ডিম সুন্দর।
আবার কয়েক মুহুর্ত দুজনেই চুপচাপ থাকি। তারপর মেমসাহেব আবার বলে, আমি কালো কুচ্ছিৎ বলে আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছেন?
জান দোলাবৌদি, কোন কারণ ছিল না। কিন্তু তবুও দুজনে মুচুকি হাসতে হাসতে বেশ কিছুক্ষণ তর্ক করলাম। প্ৰথম প্রথম প্ৰেমে পড়লে এমন অকারণ অনেক কিছুই করতে হয়, তাই না? তবে শেষে আমি বলেছিলাম, সত্যি আপনার চোখ দু’টো বড় সুন্দর।
পরে বিদায় নেবার আগে বলেছিলাম, প্ৰথম পরিচয়ের দিনই আপনার সৌন্দৰ্য নিয়ে আলোচনার জন্য যদি কোন অন্যায় হয়ে থাকে তো মাপ করবেন।
তুমি তো মেমসাহেবকে দেখেছ। সত্যি করে বল তো, ওর চোখ দু’টো সুন্দর কিনা। অত কালো টান টানা ঘন গভীর বুদ্ধিদীপ্ত চোখ আমি তো জীবনে কোথাও দেখিনি। ঐ চোখ দু’টো আমাকে চুম্বকের মত টেনে নিয়েছিল। সেই সেদিন দানাপুর প্যাসেঞ্জারের কামরায় মেমসাহেবের প্রথম দেখা পাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি বেশ উপলব্ধি করেছিলাম। আমার নিঃসঙ্গ জীবনের শেষ হতে চলেছে। ময়দানে মেমসাহেবের পাশে বসে আমার সে উপলব্ধি আরো দৃঢ় হলো। বেশ বুঝতে পারলাম জীবনদেবতা আমাকে জানারণ্যের মধ্যে হারিয়ে যেতে দেবেন না। নিঃশব্দে নিভৃতে তিনি আমার কাছে মেমসাহেবকে পাঠিয়েছেন আমার জীবনযুদ্ধের সেনাপতিরূপে।
আমার নতুন সেনাপতিও বোধহয় বুঝতে পেরেছিল যে বিধাতাপুরুষ। শুধু একটু হাসি, একটু গান, একটু সুখ, একটু আনন্দ, একটু ভাললাগার জন্য তাকে আমার কাছে টেনে আনেন নি।
দু’চারদিন আরো দেখাশোনা হবার পর একদিন সন্ধ্যায় পার্ক সার্কাস ময়দানের এক কোণায় বসে মেমসাহেবকে আমার জীবনকাহিনী শোনালাম। সব কিছু শুনে মেমসাহেব বলেছিল, ধাতুটা ভাল। তবে খাদ মিশে গেছে। গহনা গড়বার জন্য একটু বেশী পোড়াতে হবে, একটু বেশী পেটাতে হবে।
কাকে পোড়াবেন? কাকে পেটাবেন?
বুঝতে পারছেন না?
বুদ্ধি থাকলে তো বুঝব।
এবার একটু হেসে একটু জোর গলায় বললে, আপনাকে।
আমি অবাক হয়ে বলি, সে কি সর্বনাশের কথা। প্ৰায় তোৎলামী করে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি আমাকে পোড়াবেন, পেটাবেন?
মেমসাহেব গাম্ভীৰ্য আনার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে বলল, তবে কি আপনাকে পূজা করব?
একটু পরে বলেছিল, দেখবেন, আপনাকে কেমন জব্দ করি, কেমন শাসন করি।
সত্যি?
নিশ্চয়ই।
পারবেন? নিশ্চয়ই। বেশ আত্মপ্ৰত্যয়ের সঙ্গে মেমসাহেব জবাব দেয়। পাছে হেরে যান, সেই ভয়ে মা পৰ্যন্ত আগে আগেই পালিয়েছেন, সুতরাং আপনি কি…!
আরো কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। ইতিমধ্যে মেমসাহেব নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিল। আমি পরীক্ষা দিয়ে কোনমতে পাশ করেছি। কিন্তু ঠিক লেখাপড়া বিশেষ কিছু করিনি। তাই বলল, রোজ একটু পড়াশুনা করবেন।
সে কি? এই বুড়ে বয়সে আবার পড়াশুনা করব?
সোজা জবাব আসে, বাজে তর্ক করবেন না। নিশ্চয়ই রোজ একটু পড়াশুনা করবেন।
ডজন খানেক খবরের কাগজ আর ডজন খানেক জার্নাল তো রেগুলার পড়ি।
খবরের কাগজে কাজ করতে হলে শুধু খবরের কাগজ পড়লে চলে না, আরো কিছু পড়া দরকার
আমি চুপ করে থাকি। বসে বসে ভাবি মেমসাহেবের কথা।
মেমসাহেব বলে, একটা কথা বলবেন?
বলব।
আপনি আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছেন, তাই না?
না, না, বিরক্ত হৰো কেন?
তবে এত গম্ভীর হয়ে ভাবছেন কি?
দৃষ্টিটিা উদাস হয়ে যায়। মনটা উড়ে বেড়ায় অতীত-বৰ্তমানের–সমস্ত আকাশ জুড়ে। শুধু বলি, একটুও বিরক্ত হচ্ছি না। শুধু ভাবছি। কেউ তো আমাকে এসব কথা আগে বলে নি…!
তাতে কি হলো?
এমনি করে এগিয়ে চলে আমাদের কথা। শেষে মেমসাহেব বলে, চিরকালই কি আপনি একটা অর্ডিনারী রিপোর্টার থাকবেন?
মাত্র একশ পঁচিশ টাকা মাইনের সেই রিপোর্টার হবার সুযোগই আজ পর্যন্ত পেলাম না; সুতরাং কল্পনা করে আর কতদূর যাব?
স্পষ্ট জানিয়ে দেয় মেমসাহেব, ওসব কথা বাদ দিন। অতীত আর বর্তমান নিয়েই তো জীবন নয়, ভবিষ্যতই জীবন।
অতীত আর বর্তমানের ক্ষয়রোগে ভুগতে ভুগতে মেরুদণ্ডটা ভেঙে গেছে। তাই ভবিষ্যতে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারব বলে ভরসা পাই না।
কথাটা ঠিক হলো না। অতীত-বৰ্তমান হচ্ছে ক্যানভাস আর ব্যাকগ্ৰাউণ্ড মাত্ৰ, ছবিটা এখনও আঁকা বাকি।
যাই হোক শেষে মেমসাহেব বলল, অতীত-বর্তমান নিয়ে আত মাথা ঘামাবেন না, ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে তৈরি করুন। ক্লাসিকস পড়ুন, ভাল ভাল লিটারেচার পড়ুন।
সাধারণত ছেলেমেয়ের ছাত্রজীবনে পড়াশুনা করে। প্ৰথম কথা, আমাকে গাইড করার কেউ ছিল না। দ্বিতীয়ত ছাত্রজীবনে সে সুযোগ বা অবসরও পাইনি। পরীক্ষায় পাশ করবার জন্য কিছু ইংরেজি-বাংলা সাহিত্য পড়তে বাধ্য হয়েছি। তাছাড়া বঙ্কিমচন্দ্ৰরবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্ৰ ইত্যাদি কোন না কোন কারণে বা উপলক্ষে পড়েছি। কদাচিৎ কখনও কোন দুর্ঘটনার জন্য জনসন বা টি. এস ইলিয়টও হয়ত পড়েছি। কিন্তু ঠিক পড়াশুনা বলতে যা বোঝায়, তা আমি করতে পারিনি। মেমসাহেবের পাল্লায় পড়ে এবার আমি সত্যি সত্যিই একটু পড়াশুনা করা শুরু করলাম।