কণ্ঠস্বর অপরিচিত নয়। তাই উত্তর আসে, আমি গার্গী।
এক মুহুর্ত পরেই আমাকে প্রশ্ন করেন মিস গার্গী চক্রবর্তী, অনেকদিন পর আজ আপনার টেলিফোন ডিউটি পড়ল, তাই না?
উত্তর দিই, না। অনেকদিন কোথায়…
গার্গী মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে জানতে চায়, কাল আর পরশু। আপনি অফিসে আসেন নি?
কেন বলুন তো।
আগে বলুন কোথায় ছিলেন দুদিন।
কোথায় আবার থাকবে, কলকাতাতেই ছিলাম। তবে। কালকে আমার অফ ছিল। আর পরশু অনেক রাত্রে অফিসে এসেছিলাম।’
তাই বুঝি?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
গার্গী চক্রবর্তী টেলিফোন ছাড়ে না। ইনিয়ে-বিনিয়ে দু’চারটে আলতু-ফালতু কথার পর জিজ্ঞাসা করল, তারপর আপনি কেমন আছেন?
হঠাৎ আজ পঞ্চাশ টাকা মাইনের রিপোর্টারের এত খবর নিচ্ছেন, কি ব্যাপার?
যাস্ট এ মিনিট বলে গার্গী অন্য কাউকে লাইন দিতে গেল। আমি টেলিফোন ধরে রইলাম। একটু পরেই ফিরে এলে আমার লাইনে। বলল, কাল-পরশু আপনার অনেক টেলিফোন এসেছিল।
আমি গার্গীকে দেখতে পাই না। কিন্তু বেশ অনুভব করতে পারছিলাম ওর হাসিখুশী ভরা মুখখানা। আমি এবার একটু ঠাট্টা করে বললাম, আমি তো মিস গার্গী চক্রবর্তী নই যে আমার অনেক টেলিফোন আসবে।
তাই বুঝি?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
গলার স্বরে একটু অভিনবত্ব এনে গার্গী বলে, অনেকে না হোক এক’জনও তো অনেকবার টেলিফোন করতে পারে-যাস্ট এ মিনিট…
গার্গী আবার লাইন দিতে চলে যায়।
আমি ভাবি কে আমাকে অনেকবার টেলিফোন করতে পারে। মেমসাহেব হয়ত একবার টেলিফোন করতে পারে। কিন্তু অনেকবার কে করল?
গার্গী এবার ফিরে এসে বলল, সত্যি বলছি। এক’জন আপনাকে অনেকবার…
কিন্তু তাতে আপনাকে এত ইণ্টারেস্ট!
কিছুই না। তবে এতদিন আপনার এই ধরনের টেলিফোন আসত না বলেই আর কি…
এবার আমার মনে সন্দেহ দেখা দিল। তবে কি মেমসাহেবই?
গার্গী বলল, ধরুন, আমি তাঁর সঙ্গে কানেকশন কয়ে দিচ্ছি।
আপনি বুঝি নাম্বারটাও জেনে নিয়েছেন?
ওদিক থেকে গার্গীর গলার স্বর শুনতে পেলাম না। একটু পরেই বলল, নিন, স্পীক হিয়ার।
আমি বেশ সংযত হয়ে শুধু সম্বোধন করলাম, নমস্কার।
নমস্কার। কি খবর বলুন?
কি আর খবর। আপনারই তো দুদিন পাত্তা নেই।
মেমসাহেব দুদিন ধরে আমাকে খোজ করেছে জেনে বেশ সুখী হলাম। তবুও ন্যাকামি করে প্রশ্ন করলাম, আপনি কি টেলিফোন করেছিলেন?
কি আশ্চৰ্য। আপনাকে কেউ বলেন নি?
আমাদের অফিস আর হরি ঘোষের গোয়ালের মধ্যে যে কোন পার্থক্য নেই সেকথা মেমসাহেবকে কি করে বোঝাই। তাই বললাম, খবরের কাগজের অফিসে এত টেলিফোন আসে যে কারুর পক্ষেই মনে রাখা সম্ভব নয়। তাছাড়া রোজই তো ডিউটি বদলে যাচ্ছে।
মেমসাহেব সঙ্গে সঙ্গে বলল, কেন। ঐ অপারেটর ভদ্রমহিলা আপনাকে বলেন নি?
গার্গী হঠাৎ আমাদের দুজনের লাইনে এসে বলে গেল, বলেছি। মেমসাহেব চমকে গেল। আমি কিন্তু জানতাম গার্গী আমাদের লাইন ছেড়ে পালাবার পাত্রী নয়।
মেমসাহেব ঘাবড়ে প্রশ্ন করল, কে উনি?
মিস গার্গী চক্রবর্তী।
হাজার হোক মেয়ে তো! গার্গীর নাম শুনেই মেমসাহেবের মনটা সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে। হয়ত বা ঈর্ষাও। তাই হেঁয়ালি করে জানতে চায়, আপনার সঙ্গে বুঝি মিস চক্রবর্তীর বিশেষ পরিচয় আছে?
আমি আপন মনেই একটু হেসে নিই। আর বলি, অধিকাংশ অপারেটরের সঙ্গেই আমাদের প্রায় সব রিপোর্টারদেরই যথেষ্ট পরিচয় আছে।
আমি আবার টিল্পানী কেটে জিজ্ঞাসা করি, কোন ছোট প্রেমের গল্পের প্লট এলো নাকি আপনার মাথায়?
বোধ করি মেমসাহেব বুঝেছিল, গার্গীর বিষয়ে আর প্রশ্ন করার প্রয়োজন নেই। বললে, কালকে আপনার সঙ্গে দেখা করে প্লটটা ঠিক করব।
আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করি, কাল দেখা হবে?
বিকেলের দিকে হতে পারে।
বিকেল পাঁচটায় লিণ্ডসে স্ট্রীটের মোড়ে আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব। আসবেন।
হ্যাঁ, আসব।
দোলাবৌদি, তুমি তো জানি কলকাতার শহরে মধ্যবিত্ত ছেলেমেয়েদের একটু প্ৰেম করা কি দুরূহ ব্যাপার। প্রেম করা ত্বে দূরের কথা, একটা গোপন কথা কইবার পর্যন্ত জায়গা নেই কলকাতায়। আমাদের শৈশবে লেকে গিয়ে প্ৰেম করার প্রথা চালু ছিল, কিন্তু পরে লেকের জলে এতগুলো ব্যর্থ প্রেমিক-প্ৰেমিকা আত্মহত্যা করল যে লেকে গিয়ে প্রেম করা তো দূরের কথা, একটু বেড়ানও অসম্ভব হলো।
এমন একটা আশ্চর্য শহর তুমি দুনিয়াতে কোথাও পাবে না। শুধু কলকাতা বাদ দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত শহরে-নগরে কত সুন্দর সুন্দর বেড়াবার জায়গা আছে। নিত্যনতুন আরো সুন্দর সুন্দর বেড়াবার জায়গা তৈরি হচ্ছে কিন্তু আমাদের কলকাতা? সেই জব চার্নক আর ক্লাইভ সাহেবের ওভারসিয়ারবাবুরা যা করে গেছেন, আমাদের আমলে তাও টিকল না। কলকাতার মানুষগুলোকে যেন একটা অন্ধকূপের মধ্যে ভরে দিয়ে চাবুক লাগান হচ্ছে অথচ তাদের চোখের জল ফেলার একটু সুযোগ বা অবকাশ নেই।
সমস্ত যুগে সমস্ত দেশের মানুষই যৌবনে প্ৰেম করেছে ও করবে। যৌবনের সেই রঙীন দিনগুলোতে তারা সবার থেকে একটু দূরে থাকবে, একটু আড়াল দিয়ে চলবে। কিন্তু কলকাতায় তা কি সম্ভব? নতুন বিয়ে করার পর স্বামী-স্ত্রীতে একটু নিভৃতে মনের কথা কইবার জায়গা কোথায়? মাতৃহারা শিশু বা সন্তানহারা পিতামাতা গলা ফাটিয়ে প্ৰাণ ছেড়ে কাঁদতে পারে না। কলকাতায়। এর চাইতে আর কি বড় ট্র্যাজেডী থাকতে পারে মানুষের জীবনে?
কেতাবে পড়েছি ও নেতাদের বক্তৃতায় শুনেছি বাঙালী নাকি সৌন্দর্যের পূজারী, কালচারের ম্যানেজিং এজেন্টস। রুচিবোধ নাকি শুধু বাঙালীরই আছে। কিন্তু হলপ করে বলতে পারি কোন নিরপেক্ষ বিচারক কলকাতা শহর দেখে বাঙালীকে এ অপবাদ নিশ্চয়ই দেবেন না। রবীন্দ্রনাথ যে কিতাবে চিৎপুর-জোড়ার্সাকোয় বসে কবিতা লিখলেন, তা ভেবে কুলকিনারা পাই না। শেক্সপিয়র বা বায়রন বা অধুনাকালের টি এস ইলিয়টকে চিৎপুরে ছেড়ে দিলে কাব্য করা তো দূরের কথা একটা পোস্টকার্ড লিখতে পারতেন না।