খুলনা ফেরার পর লুৎফর সাহেব আরো বেশী রুখে দাঁড়ালেন।
আমার অফিসে ফিরে রিপোর্ট লিখতে হবে। এত দীর্ঘ কাহিনী শোনার অবসর ছিল না। তাই ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলাম, লুৎফর সাহেব আজকাল কি করেন?
—লুৎফর সাহেব আর নেই। এই দাঙ্গায় বাগেরহাটের প্রথম বলি হলেন লুৎফর।
সে কি বলছেন?
আমাদেরও তো ঐ একই প্রশ্ন।
তবুও কি মনে হয়?
বাগেরহাটের লাহোর কটন মিলে অনেকদিন ধরেই শ্রমিক ধর্মঘট চলছে। লুৎফর সাহেব ওদের লীডার। কিছুদিন ধরেই আমরা শুনছিলাম। লুৎফর সাহেবকে শায়েস্তা করার জন্য শহরে নাকি বাইরের অনেক গুণ্ড এসেছে। আমরা কেউ বিশ্বাস করিনি।; কারণ-বাগেরহাট শহরে লুৎফর সাহেবের গায় হাত দেবার সাহস স্বয়ং ইস্কান্দার মির্জারও হয় নি। কিন্তু এরই মধ্যে সর্বনাশা দাঙ্গা শুরু হলো বুধবার সন্ধ্যার দিকে। পরের দিন বাড়ির থেকে বাইরে যাইনি। শুক্রবার সকালে দোকানটা দেখতে গিয়ে শুনি লুৎফর সাহেব শেষ।
আমি বেশ বুঝতে পারলাম। লুৎফর সাহেবকে সরাবার জন্যই লাহোর কটন মিলের মালিকদের চক্রান্তে বাগেরহাটে গণ্ডগোল বাধানো হয়েছে। কেননা, শহরের অবস্থা স্বাভাবিক থাকলে লুৎফর সাহেবকে শেষ করা যেত না।
অফিসে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হলো। বেশ ক্লান্ত বোধ করছিলাম। তবুও চটপট করে বাগেরহাটের দাঙ্গার নেপথ্য কাহিনী লিখে ফেললাম।
তাই সারাদিন মেমসাহেবের কথা ভাববার ঠিক সময় পেলাম না।
পরের দিন আমার উইকলি অফ ছিল। অফিসে গেলাম না। তার পরের দিন আমার টেলিফোন ডিউটি ছিল। তাই একটু দেরি করেই অফিসে গেলাম।
এখনকার মত তখন ডায়াল ঘুরালেই নম্বর পাওয়া যেত না। অপারেটরের ওপর নির্ভর করতে হতো। খবরের কাগজের রিপোর্টারের নাইট-টেলিফোন ডিউটি একটা বিচিত্র ব্যাপার। পুলিস, হাসপাতাল, এ্যাম্বুলেন্স, ডক, রেল-পুলিস, রেল স্টেশন, দমদম এয়ারপোর্ট ইত্যাদি জায়গার থেকে দৈনন্দিন টুকটাক লোক্যাল নিউজ পাবার জন্যে প্ৰায় শতখানেক টেলিফোন করতে হতো। আমাদের কাগজের পাড়াতে এবং একই টেলিফোন এক্সচেঞ্জে আরো চার-পাচটি কাগজের অফিস ছিল। এক্সচেঞ্জের অপারেটররা প্ৰতি রাত্রে এই লাইন দিতে দিতে প্ৰায় রিপোর্টার হয়ে উঠেছিলেন। নাম্বার বলবার প্রয়োজনও হতো না; শুধু বললেই হতো, রিভার পুলিস দেবেন নাকি?
উত্তর আসত, রিভার পুলিস এনগেজ। টাইমস অফ ইণ্ডিয়া কথা বলছে।
এখনকার মত তখন এরারপোর্ট রিপোর্টার বলে কিছু ছিল না। তাই সাধারণ ছোটখাটো খবরের জন্য এয়ারপোর্ট পুলিস-সিকিউরিটিতে রোজ রাত্তিরে ফোন করতে হতো। তাইতো রিভার পুলিস না পেয়ে বলতাম, এয়ারপোর্ট দিন।
অপারেটর সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিতেন, সিকিমের মহারাজার এ্যারাইভাল ছাড়া আর কিছু নেই।
সঙ্গে সঙ্গেই আবার হয়ত বলতেন, এবার নীলরতনের সঙ্গে কথা বলুন। কি একটা সিরিয়াস অ্যাকসিডেণ্টের খবর আছে।
সব অপারেটরই যে এইরকম সাহায্য করতেন, তা নয়। তবে অধিকাংশ মেয়েই খুব সহযোগিতা করতেন। রাত্রে টেলিফোন ডিউটি করতে করতে বহু অপারেটরের সঙ্গে অনেক রিপোর্টারেরই বেশ মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। নানা অবস্থায় রিপোর্টাররাও যেমন অপারেটরদের সাহায্য করতেন, তেমনি অপারেটররাও রিপোর্টারদের যথেষ্ট উপকার করতেন।
কোন কোনদিন খবরের চাপ বিশেষ না থাকলে অনেক সময় আমরা নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা বলতাম। এইরকম কথাবার্তা বলতে বলতেই আমরা টেলিফোন এক্সচেঞ্জের অনেক কাহিনী শুনেছিলাম। জানতে পেরেছিলাম। অনেক অফিসারের আনটোল্ড স্টোরি। কিছু কিছু কাগজে ছাপিয়ে ফাস করেও দেওয়া হয়েছিল। অপারেটরদের উপর অনেক অফিসারের খাম-খেয়ালিপনা বন্ধ হয়েছিল।
অপারেটররাও আমাদের কম উপকার করতেন না। কৈলাশনাথ কাটজু তখন পশ্চিম বাংলার গভর্নর। আর ডাঃ রায় মুখ্যমন্ত্রী। কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে দুজনের মধ্যে তীব্ৰ মত-বিরোধ দেখা দিয়েছে বলে নানা মহলে গুজব শোনা গিয়েছিল, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও মত-বিরোধের সঠিক কারণগুলো কেউই জানতে পারছিলাম না। শেষে একদিন অকস্মাৎ এক টেলিফোন অপারেটর জানালেন, জানেন, আজ একটু আগে টেলিফোনে গভর্নরের সঙ্গে চীফ মিনিস্টারের খুব একচোট…
দুদিন বাদে এই ঝগড়ার কাহিনীই আমাদের কাগজের ব্যানার স্টোরি হলো। মোটা মোটা অক্ষরে চার-কলম সামারিতে লেখা হলো, রাজভবনের সহিত সংশ্লিষ্ট অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য মহলের নিকট হইতে জানা গিয়াছে যে রাজ্য পরিচালনার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে রাজ্যপালের সহিত মুখ্যমন্ত্রীর মত-বিরোধ দেখা দিয়াছে।–
শুধু বাংলা দেশের জনসাধারণ বা রাইটার্স বিল্ডিংস-এর কিছু অফিসার নয়, স্বয়ং ডাঃ রায় ও কাটজু সাহেব পৰ্যন্ত চমকে গিয়েছিলেন এই খবরে। অনেক তদন্ত করেও ওঁরা জানতে পারেন নি। কি করে এই চরম গোপনীয় খবর ফাঁস হয়ে গেল।।
আমরা অফিসে বসে শুধু হেসেছিলাম। আর ভাবছিলাম ইচ্ছা করলে আরো কত কি আমরা ছাপতে পারতাম। কিন্তু ছাপিনি।
এইরকম আরো অনেক চমকপ্ৰদ খবর পেতাম। আমাদের অপারেটর বান্ধবীদেৱঃ মারফত ও মাঝে মাঝেই বাজার গরম করে তোলা হতো। মন্ত্রী আর অফিসারের দল কানামাছি ভেঁ-ভেঁা করে মিছেই হাতড়ে বেড়াতেন, আর আমরা মুচকি হাসতে হাসতে ঐ মন্ত্রী ও অফিসারদের ঘরে বসে। ওদের পয়সায় কফি খেয়ে বেড়াতাম।
সেদিন রাত্রে অফিসে এসে যথারীতি টেলিফোনটা তুলে জিজ্ঞাসা করলাম, কে কথা বলছেন?