শিবানী উত্তর দেন না, উত্তর দিতে পারেন না। সেই সর্বনাশের কথা বলতে গেলেই যেন কেউ গলা টিপে ধরে। মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের করতে পারেন না।
ভারতী বলেন, মা, এত বছর পরেও সেদিনের অঘটনের কথা বলতে গেলে আমরা নিজেদের সামলাতে পারি না।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, সেদিন সন্ধে সাতটা নাগাদ উডল্যাণ্ডস্ থেকে ঠাকুরপোর কাছে ফোন এলো–
ডক্টর ব্যানার্জী।
কি ব্যাপার ডক্টর চ্যাটার্জী এখন আবার টেলিফোন করছেন কেন?
আর, এম. ও. ডক্টর চ্যাটার্জী বেশ উত্তেজিত হয়েই বলেন, বার্ন স্টল্ডার্ডের ওয়ার্কস ম্যানেজার ফ্যাক্টরীতে সিরিয়াসলি ইনজিয়োর্ড হয়েছেন। আপনি এক্ষুনি চলে আসুন।
ইয়েস আয়াম কামিং।
কাম স্ট্রেট টু ও-টি টু।
ঠিক আছে।
.
ঠাকুরপো, সারাদিনই প্যান্ট-সার্ট পরে থাকতো; চেঞ্জ করতে রাত্রে শোবার আগে চান করার পর। যাইহোক এ টেলিফোন আসার দু’মিনিটের মধ্যেই ঠাকুরপো গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
মেলোমশাই কি সার্জেন ছিলেন?
ভারতী একটু হেসে বলেন, ঠাকুরপো অসাধারণ সার্জেন ছিল। এম. বি. বি. এস’ এর ফাঁইনালে সার্জারীতে গোল্ড মেডলিস্ট তারপর শুধু এম. এস. না, ও দ্বিতীয়বার গভর্নরের গোল্ড মেডেল পায়।
ও মাই গড!
দুর্বা মুহূর্তের জন্যে থেমে বলে, যাইহোক সেদিন কী হলো, তাই বলুন।
শিবানী ঠিক রাত বারোটায় ফোন করলো উডল্যান্ড-এ; ওখান থেকে ওরা বলল, ডক্টর ব্যানার্জী অপারেশন শুরু করেছেন ঠিক আটটায়। এখনও অপারেশন চলছে। এখনই বলতে পারছি না, কখন শেষ হবে।
বাবা! তার মানে, খুবই মেজর অপারশেন চলছিল।
হ্যাঁ, খুবই মেজর অপারেশন ছিল।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর ভারতী পাঁজর কঁপানো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, কি আর বলব মা। উডল্যান্ড থেকে বাড়ি ফেরার পথে হেড লাইট ছাড়া একটা লরীর সঙ্গে ঠাকুরপোর গাড়ি মুখোমুখি ধাক্কায়…
না, উনি কথাটা শেষ করতে পারেন না।
দুর্বা আঁতকে ওঠে, কি সর্বনাশ!
ও তাকিয়ে দেখে দুই মাসীমার চোখেই জল।
দুর্বা আঁচল দিয়ে ওদের দু’জনের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে, এত বছর ধরেই তো আপনারা চোখের জল ফেলছেন। আজ আর চোখের জল ফেলবেন না। আমি কারুর চোখের জল দেখলে নিজেকে সামলাতে পারি না।
শিবানী সঙ্গে সঙ্গেই একটু কষ্ট করেই হেসে বলেন, না, শিল্পী, আজ আর আমরা চোখের জল ফেলব না। তোমাকে কি আমরা কষ্ট দিতে পারি?
দুর্বা দু’হাত দিয়ে ওদের দুজনের দুটো হাত ধরে বলে, তাহলে শুনুন…
হ্যাঁ, ও গেয়ে ওঠে–
দুঃখ যদি না পাবে তো
দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে?
বিষকে বিষে দাহ দিয়ে
দহন করে মারতে হবে।
জ্বলতে দে তোর আগুনটারে
ভয় কিছু না করিস তারে,
ছাই হয়ে সে নিভবে যখন
জ্বলবে না আর কভু তবে।
এড়িয়ে তারে পালাস না রে,
ধরা দিতে হোস না কাতর।
দীর্ঘ পথে ছুটে ছুটে
দীর্ঘ করিস দুঃখটা তোর।
মরতে মরতে মরণটারে
শেষ করে দে একেবারে,
তারপরে সেই জীবন এসে
আপন আসন আপনি লবে।
দুঃখ যদি না পাবে তো…
শিবানী দুর্বার গাল টিপে আদর করে একটু হেসে বলেন, রোজ যদি তোমার কাছে একটা গানও শুনতে পারতাম, তাহলে আর কোনদিন চোখের জল ফেলতাম না।
মাসীমা, রোজ হয়তো পারব না কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি, মাঝে মাঝেই আমি আপনাকে গান শোনাব। প্লীজ, আপনি আর চোখের জল ফেলবেন না।
ভারতী ঠিক সেই সময় গলা চড়িয়ে বলেন, সারদা, আমাদের তিন কাপ কফি দেবে?
রান্নাঘর থেকেই সারদা জবাব দেয়, হ্যাঁ, বড়মা, দিচ্ছি।
একটু পরেই সারদা কফি দিয়ে যায়।
কফি খেতে খেতেই দুর্বা শিবানীর দিকে তাকিয়ে বলে, আপনারা দু’জনে কী আপন বোন? নাকি…
শিবানী ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই চাপা হাসি হেসে বলেন, এই ভারতী, তুই শিল্পীকে বল আমরা কি রকম বোন।
ভারতীও চাপা হাসি হেসে বলেন, আমরা আপন বোনও না, জ্যাঠতুতো খুড়তুতো বোনও না।
দুর্বা যেন বিশ্বাস করতে পারে না। অবাক হয়ে বলে,তবে?
ভারতী বলে যান, আমি বেথুন কলেজে চাকরি পাবার ঠিক পাঁচ বছর পর শিবানী ওখানে জয়েন করে। কি করে যে বছর খানেকের মধ্যেই আমাদের দু’জনের বন্ধুত্ব হয়ে গেল, তা বলতে পারব না।
দুর্বা হাসে; বলে, তারপর?
রোজ কলেজ ছুটির পর আমরা ঘণ্টাখানেক আড্ডা না দিয়ে বাড়ি যাই না।
রোজ?
হ্যাঁ, রোজ।
কি এত কথা বলতেন?
দুজনে দুজনের মনের কথা, সংসারের কথা ছাড়াও কত কি বিষয়ে আমাদের কথা। এইভাবে বছর খানেক কাটার পরই আমাদের দুজনের বাড়ি নিয়ে সমস্যা শুরু হলো।
বাড়ি নিয়ে সমস্যা মানে?
তখন আমরা দুজনেই ভাড়া বাড়িতে থাকি। দুজনেই বাড়িওয়ালার জন্য নিত্য অশাস্তি ভোগ করি।
অশান্তি কেন?
শিবানীদের বাড়িওয়ালার বাতিক ছিল, উনি নিজে সদর দরজা বন্ধ না করে কিছুতেই শুতে যাবেন না। অথচ ঠাকুরপো তখন সবে এস. এস. পাশ করে কর্মজীবন শুরু করেছে।
ভারতী একটু থেমে বলেন, ৩খন ঠাকুরপো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ছোট-বড় সব ধরনের অপারেশন করার জন্য অনেকগুলো নাসিং হোমে যায়। ওর ফিরতে রোজ রাত হতো। আর তাই নিয়েই বাড়িওয়ালা শুরু করতেন। অশান্তি।
আচ্ছা লোক তো।
ভাড়া বাড়িতে থাকার যে কি জ্বালা, তা আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝেছি।
আপনাদের বাড়িওয়ালা কি নিয়ে অশান্তি করতেন?
আমাদের বাড়ির মালিক ছিলেন দুই ভাই। ওদের দুজনের জাতাকলে পড়ে আমাদের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা।