দুর্বা যেন বিশ্বাস করতে পারে না। অবাক হয়ে বলে,তবে?
ভারতী বলে যান, আমি বেথুন কলেজে চাকরি পাবার ঠিক পাঁচ বছর পর শিবানী ওখানে জয়েন করে। কি করে যে বছর খানেকের মধ্যেই আমাদের দু’জনের বন্ধুত্ব হয়ে গেল, তা বলতে পারব না।
দুর্বা হাসে; বলে, তারপর?
রোজ কলেজ ছুটির পর আমরা ঘণ্টাখানেক আড্ডা না দিয়ে বাড়ি যাই না।
রোজ?
হ্যাঁ, রোজ।
কি এত কথা বলতেন?
দুজনে দুজনের মনের কথা, সংসারের কথা ছাড়াও কত কি বিষয়ে আমাদের কথা। এইভাবে বছর খানেক কাটার পরই আমাদের দুজনের বাড়ি নিয়ে সমস্যা শুরু হলো।
বাড়ি নিয়ে সমস্যা মানে?
তখন আমরা দুজনেই ভাড়া বাড়িতে থাকি। দুজনেই বাড়িওয়ালার জন্য নিত্য অশাস্তি ভোগ করি।
অশান্তি কেন?
শিবানীদের বাড়িওয়ালার বাতিক ছিল, উনি নিজে সদর দরজা বন্ধ না করে কিছুতেই শুতে যাবেন না। অথচ ঠাকুরপো তখন সবে এস. এস. পাশ করে কর্মজীবন শুরু করেছে।
ভারতী একটু থেমে বলেন, ৩খন ঠাকুরপো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ছোট-বড় সব ধরনের অপারেশন করার জন্য অনেকগুলো নাসিং হোমে যায়। ওর ফিরতে রোজ রাত হতো। আর তাই নিয়েই বাড়িওয়ালা শুরু করতেন। অশান্তি।
আচ্ছা লোক তো।
ভাড়া বাড়িতে থাকার যে কি জ্বালা, তা আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝেছি।
আপনাদের বাড়িওয়ালা কি নিয়ে অশান্তি করতেন?
আমাদের বাড়ির মালিক ছিলেন দুই ভাই। ওদের দুজনের জাতাকলে পড়ে আমাদের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা।
কেন?
এক ভাই নিয়মিত টাকা অ্যাডভান্স নিতেন আর অন্য ভাই আমাদের তাড়াবার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিলেন।
আচ্ছা মজার ব্যাপার।
শিবানী বলেন, হারে ভারতী, সব ডিটেল-এ বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে।
না, না, ডিটেলস্-এ বলব না।
ভারতী একটু থেমেই আবার শুরু করেন, আমরা এর মধ্যে এর-ওর বাড়ি যাতায়াত শুরু করেছি। দুটো পরিবারের মধ্যে বেশ মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। যাইহোক আমরা দুজনে ঠিক করলাম, যেভাবেই হোক আমাদের নিজেদের বাড়ি করতে হবে। বাড়িওয়ালাদের জ্বালাতন-খামখেয়ালীপনা আর সহ্য করব না।
আচ্ছা।
হ্যাঁ, আমরা দু’জনে মন্ত্রী আর কয়েকজন অফিসারদের কাছে যাতায়াত করতে করতে শেষ পর্যন্ত সল্টলেকের এই দুটো জমি পেলাম।
দুই মেলোমশাই নিশ্চয়ই খুব খুশি হলেন?
ভারতী একটু হেসে বলেন, তুমি শুনলে অবাক হবে জমির কথা ওদের আমরা কিছু জানাইনি।
শিবানী বলেন, আমরা দু’জনে তো সংসারে টাকা দিতাম না। সুতরাং ব্যাঙ্কে বেশ টাকা ছিল। ভারতী নিজের টাকাতেই জমি কিনতে পারলেও আমার টাকা কম পড়লো। কিছু টাকা ভারতী দিল আর কিছু টাকা কলেজ থেকে অ্যাডভান্স নিলাম।
ভেরি ইন্টারেস্টিং।
তারপর ঠাকুরপো আর আমার কর্তাকে রাজি করিয়ে সবাই মিলে পুরী গেলাম। ওখানে গিয়ে ওদের দুজনকে আমাদের জমির দলিল দেখাতেই ওরা চমকে গেল।
তারপর আপনারা বাড়ি বানালেন?
হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত অনেক কাণ্ড করে আমাদের দুটো বাড়ি হলো।
শিবানী বলেন, তবে বাড়ি তৈরি হয়েছে শুধু দাদার জন্য। সব ঝক্কি-ঝামেলা উনি একলা হাতে সামলেছেন।
ভারতী এক ঝলক বন্ধুকে দেখে নিয়েই চাপা হাসি হেসে দুর্বাকে বলেন, এবার একটা মজার কথা বলব?
হ্যাঁ, বলুন।
নিজেদের নতুন বাড়িতে আসার আনন্দে এক বছরের মধ্যেই শিবানীর পেটে তাতাই এলো।
দুর্বা হো হো করে হেসে ওঠে।
শিবানী কোন মতে হাসি চেপে বলেন, আচ্ছা ভারতী, তোর কি কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই?
এইসব হাসি-ঠাট্টা থামার পর শিবানী একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, জানো শিল্পী, দাদা আর ভারতী আমার পাশে না থাকলে এই মহা সর্বনাশের পর আমি ঠিক আত্মহত্যা করতাম। দাদা যে আমাকে কি স্নেহ করেন, তা তুমি কল্পনা করতে পারবে না।
ভারতী একটু হেসে বলেন, আমার স্বামীকে আমি একটা কথা হাজার বার বললেও উনি কানে তোলেন না। সব ব্যাপারেই উনি নির্বিকার ভোলানাথ কিন্তু বৌমা যদি একটা কথা একবার বলে, তাহলে ভোলানাথ সে কাজ না করে শান্তি পান না।
তুই সব সময় দাদাকে ভোলানাথ ভোলানাথ বলবি না তো! দাদার মত মানুষ দশ-বিশ লাখে একটা হয় না, তা জানিস?
শিবানী একটু অভিমান করেই বলেন।
ভারতী হঠাৎ বেশ গম্ভীর হয়ে বলেন, আচ্ছা বাবা, তোর দাদাকে আর ভোলানাথ বলব না। হয়েছে তো?
দুর্বা শুধু হাসে।
খেতে বসার আগে শিবানী বলেন, শিল্পী, চল, তোমাকে আমার বাড়ি দেখাই।
হ্যাঁ, মাসীমা, চলুন।
প্রথম ঘরটায় ঢুকতে না ঢুকতেই ভারতী বলেন, দুর্বা, এটা ছিল ঠাকুরপোর ঘর।
দুর্বা চারদিকে তাকিয়ে দেখে। যাঁকে আর কোনদিন কেউ কাছে পাবে না, সব দেয়ালে শুধু তারই ছবি। শুধু একটা ছবির নচে লেখা আছে–ডাঃ তপোব্রত বন্দোপাধ্যায়। তার নীচে দুটি সন-তারিখ-জন্মদিন আর মৃত্যুদিন।
দুর্বা দু’চোখ ভরে ছবিগুলো দেখতে দেখতে বলে, কি সুন্দর দেখতে ছিলেন মেসোমশাই।
দুর্বা, ঠাকুরপো শুধু দেখতে সুন্দর ছিল না, অসাধারণ ভাল সার্জেন ছাড়াও ওর স্বভাব-চরিত্রের কোন তুলনা ছিল না।
ভারতী মুহূর্তের জন্য থেমেই একটু হেসে বলেন, কিছুদিন পর তাতাই এই ঘরে বসবে।
হঠাৎ দুর্বা মুখ ঘুরিয়ে ভারতীর দিকে তাকিয়ে বলে, তাতাই এই মাসীমার ছেলে?
হ্যাঁ।
আর বাবাই কে?
শিবানী এক গাল হেসে বলেন,আমাদের দুজনের পেটে একটা করে ছেলে হলেও আমরা দুজনেই দুটো ছেলের মা।
শুনে দুর্বা খুশির হাসি হাসে। তারপর বলে, আপনাদের দুটো ছেলে কী করছেন? পড়াশুনা নাকি…