প্রেয়সী ধীর পদক্ষেপে আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
.
আমি পাশ ফিরে শুয়ে শূন্য দৃষ্টিতে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ভাবি, একি করলাম? আমি ভাইদার স্ত্রী গায় হাত দিলাম! ওকে মারলাম। ছি! ছি!
আমি দুঃখে, অনুশোচনায় মরে যাই। আরো কত কি ভাবি! আমি কি জীবনে কোনদিন ওর সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো? ও যদি আর কোনদিন আমার সঙ্গে কথা না বলে, তাহলে মা-বড়মা জ্যেঠু-ভাইদা কি মনে করবে?
ভাবতে গিয়েও আমার মাথা ঘুরে ওঠে।
আকাশ-পাতাল আরো আরো কত কি ভাবি কিন্তু কোন কুলকিনারা পাই না। আমি নিজেকেই নিজে ঘেন্না করতে শুরু করি। একবার মনে হলো, একটা চাবুক দিয়ে নিজেকে পেটাই।
কিন্তু না, আমি কিছুই করি না। আমি প্রাণহীন পাথরের মূর্তির মত শুয়ে থাকি নড়তে-চড়তেও যেন ভয় করে।
এভাবে কতক্ষণ কাটলো, তা জানি না।
তারপর কি যেন একটা অদ্ভুত শব্দ হঠাৎ আমার কানে আসে। দশ-পনের মিনিট ভালভাবে খেয়াল করার পর মনে হলো, অনেক দূরে কে যেন কাঁদছে। কিন্তু…
প্রেয়সী না তো?
এবার আমি না উঠে পারি না। ধীর পদক্ষেপ দু’এক পা এগুতেই স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, অন্য কেউ না, প্রেয়সীই কাঁদছে।
নাইট ল্যাম্পের আবছা আলোয় এগিয়ে গিয়ে দেখি, ও ঘরের বিছানা খালি। তারপর দেখি, দরজার পাশে মেঝেতে বসে মাথায় হাত দিয়ে প্রেয়সী কঁদছে। আমি আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করি না। এগিয়ে ওর দুটি পা ধরে বলি, প্রেয়সী, তুমি আমাকে ক্ষমা করো। আমি মুহূর্তের জন্য বোধহয় মানুষ ছিলাম না বলেই এমন জঘন্য অন্যায় করেছি। তুমি আমাকে ক্ষমা না করলে আমি আর কলকাতায় যেতে পারবো না।
ও কোন কথা না বলে আমার হাত দুটো সরিয়ে দেয়। দু’এক মিনিট ও কোন কথা বলে না। তারপর মুখোনা তুলেই আবার নামিয়ে নিয়ে বলে, আমিও একটা খুব খারাপ কাজ করেছি।
কী করেছ?
তোমার ডায়েরীর অনেকগুলো পাতা পড়েছি।
বেশ করেছ।
আমি ওর মাথায় মুখে হাত দিয়ে বলি, প্রেয়সী, প্লীজ এভাবে বসে থেকো না।
আমি ওর হাত দুটি ধরে বলি, ওঠো।
হ্যাঁ। ও আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। আমি ওর হাত ধরে বাথরুমে নিয়ে যাই চোখে-মুখে জল দেবার পর তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে দিই। তারপর ওর হাত ধরে আস্তে আস্তে আমার ঘরে নিয়ে আমার বিছানায় শুইয়ে দিই। আমিও পাশে শুই।
আমি ওর একটা হাত দুটো হাতের মধ্যে নিয়ে বলি, তুমি ঠিকই বলেছিলে; আমি তোমার সব চাইতে কাছের মানুষ হবো, তুমিও আমার সব চাইতে কাছের মানুষ হবে। তোমার এই বিশ্বাস, আস্থা কোনদিন আমি হারাতে পারবো না।
আমি আলতো করে একটু টান দিতেই প্রেয়সী পাশ ফিরে শোয়। নিঃশব্দে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমিও ওর চোখ থেকে দৃষ্টি সরাতে পারি না।
এই নীরবতার মধ্যেই বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায়।
আমি ওর মুখের উপর হাত রেখে বলি, তোমার ছেলের নাম হবে বিবেক, মেয়ের নাম হবে প্রেরণা। তুমি আর ভাইদা আপত্তি না করলে তোমার প্রথম সন্তানকে আমি মানুষ করবো।
প্রেয়সীর মুখে একটা হাসি ফুটে ওঠে তারপর বলে, পারবে?
নিশ্চয়ই পারবো।
আমার মুখের উপর একটা হাত রেখে বলে, আমি হাসি মুখে আমার সন্তানকে তোমার হাতে তুলে দেব কিন্তু একটা কথা বলো।
বলল, কি জানতে চাও।
আমার সন্তানকে কেন রাখতে চাইছো?
ভাইদা আর তোমার অর্ধেক তো তোমার সন্তানের মধ্যে পাবো, ওকে নিয়েই আমার জীবন বেশ আনন্দে কেটে যাবে।
ও আমার হাতে আলতো করে চুমু খেয়ে বলে, তুমি একটা আস্ত পাগল।
হঠাৎ ঘরের মধ্যে আলো দেখেই জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাই।, অন্ধকার রাত্রির মেয়াদ শেষ, রাজার রাজা দিবাকর আসছেন।
প্রেয়সী, দেখো, দেখো, অন্ধকার শেষ; একটু পরেই সূর্যের আলোয় ভরে যাবে চারদিক।
ও খুব আস্তে আগে গেয়ে ওঠে–
আলো আমার, আলো ওগো,
আলো ভুবন-ভরা,
আলো নয়ন-ধোওয়া আমার,
আলো হৃদয়-হরা।…