ঠিক আছে।
যাবার দিন বড়মা একটা খুব সুন্দর ব্যাঙ্গালোর সিল্কের শাড়ি মৃণালিনীকে দিয়ে বলেন, মা, তুমি এই শাড়িটা পরবে। এর সঙ্গে ব্লাউজ পিস্ আছে; বানিয়ে নিও। তারপর এই শাড়ি পরে একটা ছবি তুলে আমাদের পাঠাবে।
মৃণালিনী -বড়মাকে প্রণাম করে বলে, মা ছাড়া অন্য কেউ আমাকে কোন উপহার দেয় নি আপনাদের কাছ থেকেই প্রথম উপহার পেলাম।
ও প্রায় কেঁদে ফেলেছিল। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলে, হ্যাঁ, ছবি পাঠাবো।
এয়ারপোর্টে আমি আর মৃণালিনী ওদের তিনজনকে প্রণাম করি ওরা আমাদের বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে আদর করেন।
মা মৃণালিনীর থুতনি ধরে বলেন, আমারা এসেছিলাম ছেলেকে দেখতে। ছেলেকে দেখা ছাড়াও তোমার মত সোনার টুকরো মেয়েকেও আমরা পেলাম।
মৃণালিনী একটু হেসে বলে, মা, আপনাদের চাইতে আমার ঝুলিতে অনেক বেশি জমা হলো। আমি দুটো মা ছাড়াও একটা জ্যেঠু পেলাম।
জ্যেঠু ওকে বলেন, আমি বেশ অহঙ্কারী হয়ে কলকাতা যাচ্ছি। এবার থেকে সবাইকে জোর গলায় বলব, শুধু আমাদের ছেলে না, মেয়েও এম. এস।
.
এই পৃথিবী বার বার রঙ বদলায়। গ্রীষ্মের দাহ শেষ হয় বর্ষার আগমনে পচা ভাদ্দরে যখন মন বিষণ্ণতায় ভরে যায়, তখনই শরতের নীল আকাশে টুকরো টুকরো সাদা মেঘের নাচানাচি দেখে আমাদের মন আনন্দে ভরে যায়। আবার বসন্তের মাদকতার পিছনেই লুকিয়ে থাকে শীতের জড়তা। মানুষের জীবনেও একইভাবে চলে আলো-আঁধারের খেলা।
সেদিন রবিবার; আমার আর মৃণালিনীর অফ ডে। আন্টিকে ব্রেকফাস্ট খাইয়ে দিচ্ছিল মৃণালিনী; হঠাৎ উনি ঢলে পড়লেন। ওর বিকট চিৎকার শুনে ছুটে গেলাম আমি কিন্তু দেখলাম, উনি সব সুখ দুঃখের সীমানা ছাড়িয়ে এক অজানা দুনিয়ায় পাড়ি দিয়েছেন। আর্তনাদ ও বিলাপে মৃণালিনী কিছুক্ষণের জন্য মুছাও গেল।
তারপর?
ডাঃ মাথাই থেকে শুরু করে হাসপাতালের এক দল ডাক্তার-নার্স-কর্মীর চোখের সামনে সূর্যাস্তের বিষণ্ণ আলোয় আন্টির মরদেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেল।
খবর পেয়ে কলকাতা থেকে ছুটে এলেন মা-বড়মা আর বম্বে থেকে এলেন দেশপাণ্ডে পরিবারের পরমাত্মীয়ের মত প্রতিবেশী দম্পতি সদাশিব পাতিল ও শ্ৰীমতী প্রমীলা পাতিল। ওদের চারজনকে কাছে পেয়ে মৃনালিনী একটু স্বাভাবিক হয়।
অধ্যাপক পাতিল একদিন আমাকে বলেন, মৃণালিনী সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হলে আপনি একটা বিষয়ে ওর সঙ্গে আলোচনা করবেন।
কী বিষয়ে?
মৃণালিনীদের বোম্বের বাড়িটা তৈরি করেছিলেন ওর ঠাকুর্দা। পুরনো বাংলো ধরনের বাড়ি কিন্তু চারপাশে প্রচুর জমি।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন ক্যান ইউ ইমাজিন শিবাজী পার্কের কাছে প্রায় দু’একর জমির উপর ওদের বাড়ি।
বলেন কি?
এখন ঐ জমির দাম দেড়-দু কোটি টাকা।
মাই গড!
আমার মত হচ্ছে, মৃণালিনী ঐ জমি-বাড়ি বিক্রী করে দিক। ওখানে যে মাল্টি স্টোরি হবে, তাতে দু’একটা ফ্ল্যাট ছাড়াও মোটা টাকা পাবে।
অধ্যাপক পাতিল একবার নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, আমার মনে হয়, এটাই বাস্তব ব্যবস্থা হবে। এই বিষয়ে আপনি ওর সঙ্গে আলোচনা করলে খুব ভাল হয়।
হ্যাঁ, করবো কিন্তু একমাস দু’মাস পরে করবো।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই করবেন। আমরা কাল চলে যাবো বলেই আজ আপনাকে এইসব কথা বললাম।
পাতিল দম্পতি চলে যাবার পরদিনই -বড়মাও কলকাতা গেলেন। মৃণালিনী শুরু করলো হাসপাতাল যাওয়া। সঙ্গে সঙ্গে ও আরো বেশি আমাকে আঁকড়ে ধরে।
রাত্রে আমার গলা জড়িয়ে শুয়ে বলে, তুমি পাশে না থাকলে আমি কিছুতেই এই বিপদ সামলে স্বাভাবিক হতাম না। তাছাড়া মা-বড়মা আর পাতিল আংকল আন্টি দেশের দুই প্রান্ত থেকে এলেন বলে মনে হলো, মা চলে গেলেও আমি একেবারে নিঃসঙ্গ হইনি।
মৃণালিনী, তুমি যেভাবে তোমার মা-র সেবা-যত্ন করতে, তা চোখে না দেখলে আমিও বিশ্বাস করতে পারতাম না। তোমাকে নিয়ে আন্টির যে কত শান্তি, কত গর্ব ছিল, তা তুমি ভাবতে পারবে না।
ও একটু হেসে বলে, মা বুঝি তোমাকে এইসব বলতেন?
প্রতিদিন বলতেন।
আস্তে আস্তে ও আরো স্বাভাবিক হয়। ওর মুখে হাসি ফুটে ওঠে, চোখের চাহনিতে দেখা যায় মাদকতার ইঙ্গিত। তারপর হঠাৎ একদিন রাত্রে শোবার পর পরই শুরু হয় ওর পাগলামী।
আমি নিশ্চিন্ত হলাম। মৃণালিনী আবার সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়েছে।
.
মাস দেড়েক পরে একদিন রাত্রে ভাইদার ফোন-ভাইয়া, একটা বড় প্রজেক্টের কাজে আমাকে তিন সপ্তাহ হায়দ্রাবাদ থাকতে হবে।
কবে হায়দ্রাবাদ যাবে?
আমাকে সামনের সোমবার পৌঁছতে হবে।
তুমি আমার কাছে আসবে না?
হায়দ্রাবাদ যাবো আর তোর কাছে যাবো না, তাই কখনো হয়?
ভাইদা না থেমেই বলে, আমি শনিবার তোর কাছে আসছি; ওখান থেকে সোমবার সকালের ফ্লাইটে হায়দ্রাবাদ যাবো।
ভেরি গুড।
আবার ফেরার পথেও তোর কাছে যাবো।
ভেরি ভেরি গুড!
আমি হাসতে হাসতে চিৎকার করে বলি, থ্রী চিয়ার্স ফর ভাইদা।
শনিবার এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখি, শুধু ভাইদা না, প্রেয়সীও এসেছে।
আমি কোনমতে হাসি চেপে বলি, ও ভাইদা, সঙ্গে এই পোঁটলা নিয়ে এসেছে কেন?
ভাইদা একটু হেসে বলে, ও এমন কাণ্ড শুরু করলো…
এমন কাণ্ড মানে?
ও শুধু রার বার. সবাইকে বলে, তোমরা সবাই বয়ফ্রেন্ডের কাছে যাচ্ছো কিন্তু আমাকে কেন কেউ নিয়ে যাচ্ছে না?
ও মাই গড!
তারপর মা-বাবা-ছোট মা বললেন, ওকে নিয়ে যেতে। ওর টিকিট কাটলাম তো এয়ারপোর্টে এসে।