আমি মুহূর্তের জন্য না থেমেই বলি, বড়মা, ভাইদা আর প্রেয়সী আসছে না?
তোর ভাইদা এখন শুধু ঘুমুতে বাড়ি আসে। সকাল সাতটার মধ্যে বেরিয়ে যায় আর ফিরতে রাত দশটা-সাড়ে দশটা।
বড়মা একটু থেমেই বলেন, আমাদের সল্টলেকে কত চুরি-ডাকাতি হয়, তা তো তুই ভাল করেই জানিস। তাই দুটো বাড়ি শুধু দুই মাসীর উপর ছেড়ে রেখে যাওয়া যায় না।
এর পর ভাইদা একটু সুযোগ পেলেই যেন…
সে কথা আর আমাকে বলতে হবে না। তোর কাছে যাবার জন্য ওরা দু’জাই পা বাড়িয়ে আছে।
ঠিক আছে। আমি এয়ারপোর্টে থাকব আর মনে রেখো, কাল তোমাদের তিনজনকে ঘুমুতে দেব না।
ভয় দেখাচ্ছিস কি! আমরাও তোকে ঘুমুতে দেব না।
আমি রিসিভার নামিয়ে রাখতেই মৃণালিনী বলে, তোমার কাছে ওদের তিনজনের কথা এত শুনি যে আমিও ওদের দেখার জন্য হাঁ করে বসে আছি।
আমি একটু হেসে বলি, মৃণালিনী, ওদের তিনজনকে তোমার যেমন ভাল লাগবে, সেইরকম ওরাও তোমাকে ঠিক মেয়ের মতই স্নেহ করবেন।
হ্যাঁ, সে বিশ্বাস আমার আছে।
আমরা পাশাপাশি শুয়ে কথা বলি।
মৃণালিনী, কাল সকালে হাসপাতালে গিয়েই ওদের তিনজনের খাবার-দাবারের ব্যাপারে…
শুভ, ওদের খাবার-দাবারের ব্যাপারে তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না। আমি মিঃ রেড্ডির সঙ্গে কথা বলে সব ব্যবস্থা করবো। তুমি ডাঃ মাথাইকে বলে একটা বড় গাড়ির ব্যবস্থা করো।
উনি কিছু মনে করবেন না তো?
না, না, কিছু মনে করবেন না বরং খুশি হবেন। মৃণালিনী একটু থেমে বলে, যখন আমি পারবো না, তখন তুমি ওদের নিয়ে বেরুবে; আবার যখন তোমার সময় হবে না, তখন আমি ওদের নিয়ে বেরুব।
হ্যাঁ, তাহলে খুব ভাল হবে।
ও একটু হেসে বলে, শুভ, তুমি আমাকে যত অপদার্থ ভাবো, আমি ঠিক তত অপদার্থ না। একটু বুদ্ধিসুদ্ধি আছে।
মৃণালিনী; তুমি যেভাবে আষ্টির দেখাশুনা সেবা-যত্ন করছে, তা দেখে কেউ তোমাকে অপদার্থ মনে করবে না।
ওপাশ ফিরে আমার গলা জড়িয়ে বলে, আর কথা বলো না। এবার ঘুমোণ্ড সাড়ে পাঁচটায় দু’জনকেই উঠতে হবে।
হ্যাঁ, আমরা দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
পরের দিন সকালে ডাঃ মাথাইকে সব কথা বলতেই উনি একটু হেসে বলেন, আজ দুপুরেই তোমাকে একটা বড় গাড়ি দিয়ে দেব। ওরা যে কদিন থাকবেন সেই ক’দিন এইগাড়ি তোমার কাছেই থাকবে। দ্বিতীয়তঃ তোমার আর মৃণালিনীর ডিউটি সকাল আর আফটারনুন-এ থাকবে, যাতে তোমরা একজন ওদের কাছে থাকো।
আমি খুশির হাসি হেসে বলি, স্যার, দ্যাট উড বী ফাইন।
আগে আমার কথা শোনো।
হ্যাঁ, স্যার, বলুন।
তুমি একদিন ওদের মাইশোর নিয়ে যেও। ওদের প্রত্যেকেরই বয়স হয়েছে। সেজন্য সকালে গিয়ে বিকেলে-সন্ধেয় ফিরে আসা ঠিক হবে না। আমাদের গেস্ট হাউসেই তোমরা থাকবে।…
স্যার, মাইশোরে আমাদের গেস্ট হাউস আছে?
ডাঃ মাথাই একটু হেসে বলেন, ভারতবর্ষের পনের-কুড়িটা শহরে আমাদের গেস্ট হাউস আছে।
শুনে আমি হাসি।
উনি হাসতে হাসতেই বলেন, ওরা যেন বুঝতে পারেন, তুমি-গ্রেট অ্যাপোলো পরিবারের একজন। অল দ্য বেস্ট!
.
ওরা ঠিক এক সপ্তাহ এখানে ছিলেন। হাসপাতাল কতৃপক্ষের সহযোগিতা দেখে ওরা মুগ্ধ হন। আর প্রথম দিন খেতে বসেই জ্যেঠু চিৎকার করেন, ওরে তাতাই সোনা, এত দামী হোটেলের খাবার এনেছিস কেন?
জ্যেঠু, খাবার এসেছে হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকে।
এই খাবার তোদের ক্যান্টিনের?
হ্যাঁ।
একটু থেমে বলি, ফাঁইভ স্টার হোটেলে যত রকমের খাবার পাওয়া যায়, তার চাইতে অনেক বেশি ধরনের খাবার আমাদের ক্যান্টিনে পাওয়া যায়।
বলিস কিরে?
জ্যেঠু শুধু পেশান্টদের জন্যই সত্তর-আশি রকমের খাবার তৈরি হয়। তাছাড়া ডাক্তার-নার্স-হসপিট্যাল স্টাফ ও গেস্টদের জন্য কত কি হয়।
আশ্চর্য!
খাবার-দাবারে উপর দিয়ে চোখ বুলিয়েই উনি বলেন, এই বয়সে এত খাও? যায়?
খাবার-দাবারের ব্যবস্থা আমি করিনি; মৃণালিনী করেছে। নিন্দা-প্রশংসা সবই ওর প্রাপ্য। এবার জ্যেঠু মৃণালিনীর দিকে তাকিয়ে বলেন, মা, এই বয়সে কি আমরা এত খেতে পারি?
জ্যেঠু, আমাদের হাসপাতালে তিনজন হাইলি কোয়ালিফায়েড ডায়াটিসিয়ান আছেন। তাদের একজন ক্যালোরি ও আপনাদের শরীরের প্রয়োজন বুঝে খাবা তৈরি করেছেন।
ওর কথা শুনে মা-বড়মা হো হো করে হেসে উঠে বলেন, শোনো মেয়ে কথা।
এবার মৃণালিনী ওনাদের শাসন করে বলে, চুপচাপ খেয়ে নিন; তা না হলে তিনজনই আমার কাছে বকুনি খাবেন।
জ্যেঠু মা-র দিকে তাকিয়ে বলেন, বৌমা, চুপচাপ খেয়ে নাও তা না হলে এই বুড়ো বয়সে ডাক্তার মেয়ের বুকুনি খেতে হবে।
মহীশূরে দুপুরে পৌঁছে গেস্ট হাউসে খেয়েদেয়ে বিশ্রাম করার পর ওদের বৃন্দাবন গার্ডেন দেখিয়ে চামুণ্ডা মন্দিরে নিয়ে যাই আরতির সময়। পরদিন ব্রেকফাস্টের পর ওদের নিয়ে যাই প্যালেস দেখাতে। তারপর খেয়েদেয়ে বিশ্রাম করে ফিরে আসি ব্যাঙ্গালোর।
মা-বড়মা সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আন্টির কাছেই থাকেন। অমি বা মৃণালিনী জ্যেঠুকে নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরতে যাই; বিকেলে তিনজনকে নিয়েই বেড়াতে যাওয়া হয়। তাই সোনা, আমি আর শিবানী ব্যাঙ্গালোর সিল্কের শাড়ির দোকানে যাব।
বড়মা, আমি তো জানি না, কোন দোকানে ভাল ব্যাঙ্গালোর সিল্কের শাড়ি পাওয়া যায়। মৃণালিনী আড়াইটের মধ্যেই হাসপাতাল থেকে ফিরবে; তোমরা ওর সঙ্গে যেও।