তুমিও তো আমাকে আদর-ভালবাসায় ভরিয়ে দিয়েছ।
তুমি খুশি?
নিশ্চয়ই খুশি কিন্তু…
মৃণালিনী কথাটা শেষ করে না শুধু মুখ টিপে হাসে।
আমি বলি, কিন্তু কি?
সত্যি বলব?
হ্যাঁ, বলো।
রাগ করবে না বা আমাকে খারাপ মনে করবে না?
আমার কি মাথা খারাপ হয়েছে যে তোমাকে খারাপ মনে করব?
ও আমার মুখের উপর মুখ রেখে বলে, শুভ, আমাকে দূরে ঠেলে দিও না। তুমি মাঝে মাঝে আমাকে এইরকম আনন্দ দেবে।
আমি শুধু হাসি কোন কথা বলি না।
দু’এক মিনিট নীরব থাকার পর মৃণালিনী বলে, তুমি খুব ভাল করেই জানো, বাবা আমাদের দু’ভাই বোন আর মা-কে ফেলে নতুন বউ নিয়ে বিলেত যাবার পর থেকে কিভাবে মা আর আমার জীবন কাটছে।
ও মুহূর্তের জন্য থেমে বলে, বাবার উপর রাগ করেই আমি এম. এস. করলাম।
হ্যাঁ, তা জানি।
আমি নিশ্চয়ই তোমার মত ব্রিলিয়ান্ট ছিলাম না কিন্তু তুমি তো জানো, আমি পড়াশুনার ক্ষতি করে একটি দিনও নষ্ট করিনি বা কারুর সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করার স্বপ্নও দেখিনি।
আমি দু’হাত দিয়ে ওর মুখোনা ধরে বলি, মৃণালিনী, এইসব কি আমি জানি না? সাত-আট বছর ধরে আমি তোমাকে দেখছি, তুমিও আমাকে দেখছ। আমি তোমার সবকিছু জানি, তুমিও আমার সব খবর রাখো।
শুভ, তোমাকে এখানে পেয়ে আমি যেন হাতে স্বর্গ পেয়েছি। ঠিক যখন একলা একলা হাঁপিয়ে উঠেছিলাম, ঠিক তখনই তোমাকে কাছে পেলাম।
আমি একটু হেসে বলি, তুমি তো আমার মনের কথাই বললে। আমারও আর একা একলা ভাল লাগছিল না।
মৃণালিনী আলতো করে আমাকে চুম্বন করে বলে, আজ থেকে আমিও একলা, তুমিও একলা না।
আমি ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বলি, ঘুমোবে না?
ঘুম আসছে না।
হাতের ঘড়ি দেখে বলি, জানো, তিনটে বেজে গেছে।
বাজুক, আজ তোমার বুকের উপর শুয়ে শুয়ে সূর্য ওঠা দেখব।
মৃণালিনী, শুধু সূর্যোদয় দেখব না; আমরা সূর্যকে সাক্ষী রেখে প্রতিজ্ঞা করব, আমরা কোনদিন অন্ধকারে তলিয়ে যাব না। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দুজনে মিলে মানুষের সেবা করব।
ও পরম তৃপ্তির হাসি হেসে বলে, আমি কি শুধু শুধু নিজেকে তোমার কাছে বিলিয়ে দিলাম? তোমাকে আমি শুধু ভালবাসি না, তোমাকে শ্রদ্ধাও করি; তুমি আমার গর্ব, তুমি আমার অহঙ্কার।
দেখতে দেখতে ব্যাঙ্গালোর আসার পর তিন মাস কেটে গেল।
.
সেদিন শুক্রবার। সেদিন সকালেই আমার আর মৃণালিনীর ডিউটি তবে ওর ডিউটি অপারেশন থিয়েটারে,আমার ডিউটি ইমার্জেন্সীতে।
আন্টির খাবার হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকে বারোটার মধ্যেই শুধু পৌঁছে যায় না, ক্যান্টিনের লোকটি ওনাকে খাইয়ে আসে। মর্নিং-এ ডিউটি থাকলে দুটো আড়াইটের মধ্যেই আমাদের কাজ শেষ হয়। তারপর ক্যান্টিন থেকেই খেয়েদেয়ে বাড়ি ফিরি। বিশ্রাম করি। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হলো না।
বিকেলের দিকে আন্টির সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলাম। নানা কথাবার্তার ফাঁকে উনি আমার একটা হাতের উপর হাত রেখে বলেন, শুভ, তুমি এখানে আসায় আমার খুব লাভ হয়েছে।
আমি একটু হেসে বলি, কি লাভ হয়েছে?
সব সময় তোমাদের দু’জনে তো একই সময়ে ডিউটি পড়ে না। তাই মেয়ে যখন হাসপাতালে থাকে, তোমাকে আমি কাছে পাই। তাছাড়া রোজই কোন না কোন সময়ে তোমাদের দুজনকেই কাছে পাই।
উনি একটু হেসে বলেন, একি কম লাভ?
আমিও আপনার কাছে মায়ের স্নেহে পাচ্ছি; আপনার চাইতে আমিই বেশি লাভবান।
সাড়ে সাতটার পর পরই মৃণালিনী আন্টিকে খেতে দিল। ও আমার দিকে তাকিয়ে বলে, শুভ, তুমি স্নান করতে যাও। মাকে ঘুম পাড়িয়ে আমি আসছি।
আমি স্নান করে বিছানায় আধা-শোওয়া অবস্থায় মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি অব সার্জারির জার্নাল পড়ছিলাম। মৃণালিনী ঘরে ঢুকেই বলল, মেলবার্ন ইউনিভার্সিটির জার্নাল পড়ছো?
হ্যাঁ।
তুমি এই জার্নাল পড়া শেষ করলে তোমাকে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির জার্নাল দেব। লিভার অপারেশনের উপর দুটো অসাধারণ লেখা আছে।
হ্যাঁ, দিও।
তোমার পড়ার পর অমি দু’একটা কথা জানতে চাইব। ঠিক সেই সময় টেলিফোন। রিং শুনেই বুঝলাম, বাইরের ফোন।
মৃণালিনী একটু হেসে বলে, নিশ্চয়ই মা-বড়মার ফোন। আমি রিসিভার তুলতেই শুনি জ্যেঠুর গলা, তাতাইলোনা, আমি, বৌমা আর তোর বড়মা গঙ্গাজলে গঙ্গা পূজা করব।
আমি অবাক হয়ে বলি, তার মানে?
ওরে তাতাইসোনা, তুই আমাদের তিনজনকে মাসে মাসে পাঁচ হাজার করে টাকা পাঠাচ্ছিস, তা দিয়ে আমরা কী করবো?
তোমরা খাও-দাও, ওড়াও, দান করো বা জমিয়ে রাখো-এককথায় তোমাদের যা ইচ্ছে তাই করবে।
তাইতো বলছি, গঙ্গাজলে গঙ্গা পূজা করব বলে আমরা ঐ টাকা দিয়ে প্লেনের টিকিট কেটেছি তোর কাছে যাবো বলে।
আমি চিৎকার করে বলি, জ্যেঠু, সত্যি তোমরা তিনজনে আসছে?
আসছি মানে কালই আসছি। নে, বৌমার সঙ্গে কথা বল।
মা ‘তাতাই সোনা’ বলতে না বলতেই আমি বেশ উত্তেজিত হয়ে বলি, মা, তোমরা এলে দারুণ মজা হবে।
শুধু তুই কেন, আমরাও তো খুব আনন্দ পাবো।
মা মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, মৃণালিনীকেও খবরটা দিন।
ও এখানেই আছে; কথা বলো।
মৃণালিনী -র সঙ্গে কথা বলার পর বড়মার সঙ্গেও কথা বলে। তারপর বড়মা আমাকে বলেন, তাতাইসোনা, তোকে কাছে পাবার জন্য তিনজনেই ছটফট করছিলাম বলে শেষ পর্যন্ত তিনজনেই ছুটি নিয়ে তোর কাছে আসছি।
তোমাদের যে শুভবুদ্ধি হয়েছে তা জেনেই ভাল লাগছে।