আমাকে ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়েই মিঃ বৈদ্যনাথন বলেন, হসপিট্যাল ক্যান্টিন থেকে আজ আর কাল দু’বেলাই আপনার খাবার-দাবার আসবে। তারপর আপনি যা বলবেন, সেইরকম বিধিব্যবস্থা করা হবে।
আমি বলি, আজ একবার ডাঃ মাথাই-এর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
মৃণালিনী সঙ্গে সঙ্গে বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি তোমাকে নিয়ে যাবো।
মিঃ বৈদ্যনাধন বিদায় নেবার পর মৃণালিনী আমাকে ফ্ল্যাটটি ভাল করে দেখায়। হ্যাঁ, ফ্ল্যাটটি যেমন ভাল, তেমনই সুন্দর করে সাজানো। ড্রইংরুম, দুটো বেডরুম, একটা স্ট্যাডি, কিচেন ও তার পাশেই ডাইনিং রুম। বেডরুম সংলগ্ন বাথরুম ছাড়াও ব্যালকনি আছে।
কি শুভ, পছন্দ হলো?
আমি কোনমতে হাসি চেপে বলি, সবই ভাল কিন্তু এই ফ্ল্যাটে একলা রাত কাটাবো কি করে?
ও আলতো করে আমার গালে একটা চড় মেরে হাসতে হাসতে বলে, সে সমস্যার সমাধানও কি আমাকে করতে হবে?
আর কে করবে?
.
যাইহোক আমার নতুন জীবন বেশ ভালভাবেই শুরু হলো। ডাঃ মাথাই নিঃসন্দেহে একজন বিখ্যাত সার্জেন; তাছাড়া হাসপাতালের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি কিন্তু তাঁর ব্যবহার দেখে মনেই হলো না, এখানেই আমাদের পরিচয়। মনে হলো, উনি আমার বড় ভাই। যে প্রকৃত শিক্ষালাভ করে, সে যে বিনয়ী হয়, তার জ্বলন্ত উদাহরণ ডাঃ মাথাই। বুঝলাম, উনি সত্যি প্রফেসর রাও-এর প্রিয় শিষ্য।
আরো অনেককেই ভাল লাগলো। তবে খুব ভাল লাগলে অপারেশন থিয়েটারের এক দল নার্সের প্রধান মিস প্যামেলা নায়ারকে। বছর পঞ্চাশেক বয়স। গায়ের রঙ বেশ কালো কিন্তু মুখের হাসি ঠিক ততটাই উজ্জ্বল। সার্জিক্যাল নার্স হিসেবে অতুলনীয়া আর অসম্ভব স্নেহপ্রবণ। দিদি না, আমাদের বয়সী ডাক্তার-নার্সদের উনি সন্তানের মতই স্নেহ করেন।
অ্যাপোলোতে কাজ শুরু করার দিন পনের-কুড়ি পরের কথা। প্রায় ঘণ্টা চারেক ধরে একটা অত্যন্ত জটিল অপারেশন করার পর সবাই মিলে কফি খাচ্ছি। মিস নায়ার কফি খেতে খেতেই বলেন, ডাঃ বন্দ্যোপাধ্যায়, ইউ আর রিয়েলী এ ম্যাজিসিয়ান ইন অপারেশন থিয়েটার। বুঝলাম, কেন তুমি দু’বার প্রেসিডেন্টস গোল্ড মেডেল পেয়েছ।
আমি ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে বলি, প্লীজ, আপনি আমাকে ডাঃ বন্দ্যোপাধ্যায় বলবেন না; বলবেন, শুভ। আমি তো আপনার সন্তানের বয়সী; আমি আপনাকে আম্মা বলব।
মিস নায়ার কফির কাপ নামিয়ে দু’হাত দিয়ে আমার মুখোনা ধরে কপালে স্নেহ্নম্বন দিয়ে বলেন, বিয়ে করলে আমার ছেলেমেয়ে তোমার বয়সীই হতো। আমি তোমাকে শুভ বলেই ডাকব।
ইয়েস আম্মা, দ্যাটস ফাইন।
সব ডাক্তার-নার্সরা কফির কাপ তুলে ধরে বলেন, চিয়ার্স টু আম্মা-শুভ।
আমার আর মৃণালিনীর ডিউটি পড়ে কখনো আলাদা, কখনো একই সময়ে। যখন ও হাসপাতালে আর আমি ফ্ল্যাটে থাকি, তখন ফুরসত পেলেই আন্টির কাছে যাই।
মৃণালিনী যখন প্রথম দিল্লী আসে, তখন থেকেই আন্টি মাঝে মাঝেই ওকে দেখতে আসতেন; থাকতেন সাউথ এক্সটেনশনে এক দূর সম্পর্কের মামাতো ভাইয়ের বাড়িতে। মৃণালিনীর সঙ্গে আমিও মাঝে মাঝে গিয়েছি ওখানে। সুতরাং ওনার সঙ্গে খুবই ভাল পরিচয় ছিল; আমাকে খুবই স্নেহ করেন। মেয়ে যখন হাসপাতালে থাকে, তখন আন্টিকে একাই থাকতে হয়; লাঠি ভর দিয়ে কোনমতে ফ্ল্যাটের মধ্যে ঘোরাঘুরি করেন। তাইতো এখানে আমাকে পেয়ে উনি খুব খুশি।
কিছুক্ষণ টুকটাক কথাবার্তায় পরই আন্টি আমার হাতের উপর হাত রেখে বলেন, শুভ, এফ. আর. সি. এস. পাত্রের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে বাবা ভেবেছিলেন, মেয়ে খুব সুখে থাকবে। যখন উনি ন’বছরের ছেলে, সাত বছরের মৃণালিনী আর আমাকে ফেলে অন্য একজনকে বিয়ে করে বিলেত চলে গেলেন, তখন সে আঘাত আমি সামলে নিয়েছিলাম ছেলে-মেয়ের মুখ চেয়ে।
এইটুকু বলেই উনি হাঁপিয়ে ওঠেন। দু’এক মিনিট চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন, কত কষ্ট করে ছেলেকে এঞ্জিনিয়ারিং পড়ালাম, বিয়ে দিলাম কিন্তু সে যে ওর বাবার মতই বিশ্বাসঘাতকতা করে বিদেশ চলে যাবে, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
আন্টি, এইসব কথা যত চিন্তা করবেন, ততই দুঃখ পাবেন। আপনি কেন ভাবেন না মৃণালিনীর মত মেয়ে পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার?
হ্যাঁ, বাবা, আমি একশ বার স্বীকার করব, ওর মতো মেয়ে পেয়ে আমি যেমন সুখী, তেমনই গর্বিত।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে একবার বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, দু’দুবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে; আমি যখন-তখন চলে যেতে পারি কিন্তু মেয়েটার জন্য খুবই চিন্তা হয়। আমি ছাড়া ওর আপনজন তো কেউ নেই।
আন্টি, মেয়েকে নিয়ে অত চিন্তা করবেন না। মৃণালিনী নিশ্চয়ই ভাল থাকবে।
কিন্তু ও যে প্রতিজ্ঞা করেছে বিয়ে করবে না কিন্তু একলা একলা কি এই পৃথিবীতে থাকা যায়?
হ্যাঁ, আন্টি, নিশ্চয়ই যায়। তা না হলে পৃথিবীর কোটি কোটি নারী-পুরুষ বিয়ে না করে বেঁচে আছে কী করে?
একই সঙ্গে ডিউটি পড়ুক বা না পড়ুক, আমি আর মৃণালিনী রোজই আড্ডা দিই। তবে আন্টির শরীরের কথা ভেবে মৃণালিনী আমার ফ্ল্যাটে এসেই গল্পগুজব করতো। তবে দিনের বেলা আন্টি ঘুমুতেন না বলে ও খুব বেশিক্ষণ আড্ডা দিতে না; অধিকাংশ সময়ই মা-র কাছে থাকতো। কিন্তু রাত্রে আন্টি ঘুমুবার ওষুধ খেয়ে শোবার পর মৃণালিনী ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আমার সঙ্গে আড্ডা দিতো।