আমি সোমবার রাত্রে এসেছি শনিবার ভোরের ফ্লাইটেই আমি ব্যাঙ্গালোর যাবে। মাঝখানে মাত্র চারটে দিন। মা-বড়মার খুব ইচ্ছা ছিল ছুটি নেবার কিন্তু কলেজে পরীক্ষা চলছিল বলে তা কিছুতেই সম্ভব হলো না। তথৈ ব চ জ্যেঠু আর ভাইদার অবস্থা। অর্থাৎ সারাদিন আমি আর প্রেয়সী আড্ডা দিই।
আমি শুয়েই থাকি। ও আমার পাশেই বসে।
বয়ফ্রেন্ড, ব্যাঙ্গালোরে তোমার রান্নাবান্না কে করে দেবে।
না, না, ওসব ঝামেলায় আমি যাবো না।
তবে খাবে কোথায়?
অ্যাপেলোর ক্যান্টিন খুব ভাল। এক বেলা তো হাসপাতালই খেয়ে নেবো; সম্ভব হলে ওখান থেকেই খাবার এনে অন্য বেলা চালিয়ে দেব।
তা যদি সম্ভব না হয়?
তাহলে অন্য কোন ব্যবস্থা করবো।
কিন্তু তোমার চা-টা বা ব্রেকফাস্ট কে করে দেবে?
ওখানে যাই; তারপর দেখা যাবে।
একটু চুপ করে থাকার পর প্রেয়সী বলে, তোমাকে নিশ্চয়ই বেশ বড় ফ্ল্যাট দেবে?
দেওয়া উচিত।
তুমি এত বছর হস্টেলে কাটিয়েছ কিন্তু সেখানে তো অনেকেই থাকতো। সেখানে কথাবার্তা বলার লোকের অভাব হয়নি।
ও আমার মাথায় মুখে হাত দিতে দিতে বলে, ব্যাঙ্গালোরের অত বড় ফ্লাটে কথা বলার মত একজনও থাকবে না। তোমার কষ্ট হবে না?
কষ্ট হবে কিনা জানি না কিন্তু নিশ্চয়ই ভাল লাগবে না।
তুমি তো হাসপাতালে এক মিনিটও চুপচাপ বসে থাকতে পারবে না। তাছাড়া অপারেশনের সময় তোমাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। অত পরিশ্রম করে ফ্ল্যাটে ফেরার পর কে তোমাকে এক গেলাস জল বা এক কাপ চা দেবে, তার তো ঠিক নেই।
আমি একটু হেসে বলি, ওসব আমার অভ্যাস আছে।
তোমার অভ্যাস আছে বললেই তো আমি শান্তি পাবো না।
আমি হাসতে হাসতেই বলি, প্রেয়সী, অপাত্রের জন্য এত চিন্তা করো না।
একটু পরে আমি বলি, প্রেয়সী, অনেকক্ষণ গল্প করেছ। এবার তুমি তোমার ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম করো।
তুমি মাত্র চারদিনের জন্য এসেছ আর আমি তোমাকে একলা রেখে বিশ্রাম করতে যাবো?
একলা থাকতে তো আমার কষ্ট হয় না। তুমি যাও।
না, ও যায় না। কখনও কখনও অদ্ভুতভাবে একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে; আবার কখনো ও চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উদাস দৃষ্টিতে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমিও ওর উদ্ধত যৌবনের উপ সহ্য করে মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওকে দেখি। এক একবার মনে হয়, প্রেয়সীও কি আমারই মতন পাবার জ্বালায় জ্বলছে? নাকি ও আমাকেই চায়। আমাকে না পাবার দুঃখেই কি মনে শান্তি পাচ্ছে না?
জানি না।
শুধু সেদিনের জন্য আমার মনে এই প্রশ্ন আসেনি। পর পর চারদিন সারা দুপর এক মিনিটের জন্যও আমাকে একলা থাকতে দেয়নি। একইভাবে আমার বিছানায় আমার পাশে বসে থেকেছে। কখনও মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে দিয়েছে, কখনও আবার একটা হাত নিয়ে নাড়াচাড়া করেছে।
আমার কত কি ইচ্ছা করেছে কিন্তু পারিনি। কোনদিন সে ইচ্ছা পূর্ণ করতেও পারব না।
বয়ফ্রেন্ড, আমার একটা অনুরোধ রাখবে?
কি অনুরোধ রাখতে হবে?
আমাকে কথা দাও, আমার অনুরোধ রাখবে; তা না হলে বলে কি লাভ?
আমি একটু হেসে বলি, হ্যাঁ, তোমার অনুরোধ রাখব।
ও একগাল হেসে আমার গাল টিপে বলে, এইজন্যই তো তোমাকে ভালবাসি।
এখন আসল কথাটা বলো তো।
প্রেয়সী ঝুঁকে পড়ে আমার মুখের সামনে মুখ নিয়ে বলে, তুমি নিশ্চয়ই মাঝে মাঝে রাত্তিরের দিকে ফোন করবে কিন্তু সবার সামনে আমি আমার কথা বলতে পারব না। প্লীজ তুমি দুপুরের দিকে আমাকে ফোন করবে।
ওর কথা শুনে আমি না হেসে পারি না।
ও দু’হাতের মধ্যে আমার একটা হাত নিয়ে বলে, কি হলো? ফোন করবে তো?
মুখে না, মাথা নেড়ে বলি করব।
চারটে দিন যেন হাওয়ার উড়ে গেল। আনন্দে-বিষাদে সবাই আমাকে বিদায় জানান আমিও বিচ্ছেদের বেদনা বুকে নিয়ে কলকাতা ত্যাগ করি।
.
জীবনে প্রথম চাকরি করতে চলেছি। ভাল-মন্দ নানা চিন্তা করতে করতেই প্লেন ব্যাঙ্গালোর এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করলো। টার্মিনাল বিল্ডিং-এ পৌঁছে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছি; হঠাৎ এক নারীকণ্ঠে ‘শুভ’ ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়াতেই মৃণালিনী ছুটে এসে এক গাল হেসে আমার দুটো হাত ধরে বলে, শুভ, তুমি অ্যাপোলোয় জয়েন করছো শুনে আমি যে কি খুশি হয়েছি, তা বলতে পারবো না।
মৃণালিনী, তুমিও অ্যাপোলোতে?
ইয়েস, ইয়েস; আমি তোমার কলিগ হবো।
মাই গড! হোয়াট এ কিউরিয়াস কো-ইন্সিডেন্স। এক সঙ্গে এম. বি. বি. এস. পড়লাম, এক সঙ্গে এম. এস. করলাম, আবার এক সঙ্গে আমরা চাকরি করবো।
মৃণালিনী ছাড়া অ্যাপোলোর এক বড় কর্তাও এসেছিলেন আমাকে রিসিভ করতে। মিঃ বৈদ্যনাথন আমার হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে বললেন, ওয়েলকাম টু ব্যাঙ্গালোর টু জয়েন অ্যাপোলো ফ্যামেলী।
গাড়িতে যেতে যেতে মিঃ বৈদ্যনাথন একটু হেসে আমাকে বলেন, আপনি আর মৃণালিনী এক সঙ্গে এম. বি. বি. এস আর এস. এস, করেছেন বলে ডাঃ মাথাই আপনাকে ওর পাশের ফ্ল্যাটে থাকার ব্যবস্থা করে…
আমি এটুকু শুনেই হেসে উঠি। বলি, হ্যাঁ, ভালই হলো; চুটিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে।
আমি একটু থেমে বলি, মৃণালিনী, তোমার মা কোথায়?
এখানে আমার কাছেই আছেন।
আন্টির শরীর কেমন আছে?
তুমি তো মার শরীরের কথা জানো। এমনি মোটামুটি ঠিক আছেন কিন্তু যখন-তখন অঘটন ঘটতে পারে।
ইন্দিরা নগরের তিনতলা বাড়ির তিনতলার ছ’নম্বর ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছেই দেখি, পাশের ফ্ল্যাটের দরজায় লেখা–ডাঃ মৃণালিনী দেশপাণ্ডে! না হেসে পারি না। যেমন খুশি তেমনই বিস্মিত হই।