হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি এসো। প্লীজ দেখো, আমি আসছি তা যেন আগে থেকে কেউ জানে।
না, না, আগে থেকে কাউকে বলব না।
মোড়ের মাথাতেই আমি ভাইদার গাড়ি থেকে নামলাম। ও যথারীতি বাড়ি গেল। আমি হাঁটি হাঁটি পা পা করে নিঃশব্দে মা-র ঘরে ঢুকেই চিৎকার করি, তোমরা এখনও আড্ডায় মত্ত?
মা-বড়মা ঝাঁপিয়ে পড়েন আমার উপর।
বড়মা বলেন, তুই আসার আগে এটা খবর দিতে পারিস না?
আমি কোনমতে হাসি চেপে বলি, আমার কে আছে যে খবর দেব? তোমরা দু’জনে কলেজ আর আড্ডায় ব্যস্ত, জ্যেঠু কারখানা নিয়ে ব্যস্ত, ভাইদা কুৎসিত বউ নিয়ে মত্ত।…
ঠিক সেই সময় ভাইদা আর প্রেয়সীর প্রবেশ।
প্রেয়সী ঘরের ভিতর এগিয়ে আসতে আসতে বলে, বয়ফ্রেণ্ড, মুখ সামলে কথা বলবে। আমি কুৎসিতও না, তোমার ভাইদাও আমাকে নিয়ে মত্ত না।
নটী বিনোদিনী, বাজে বকো না। ভাইদা অফিস থেকে এসেই তো তোমার। আঁচলের তলায়…
তোমার ভাইদা অফিস থেকে এসেই আমায় আঁচলের তলায় ঢুকেছে বলেই গাড়িতে তোমার মালপত্র…
বড়মা গলা চড়িয়ে বলেন, এই শিবানী, তার মানে বাবাই এয়ারপোর্টে গিয়েছিল।
আমি আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে দু’হাত দিয়ে মা-বড়মাকে জড়িয়ে ধরি। ওরাও আমাকে বুকের মধ্যে টেনে নেন।
ওদের দুজনের আদর করার পর্ব চলতে চলতেই ভাইদা আমার মালপত্র ঘরে এনে রাখে। মালপত্র দেখেই মা প্রশ্ন করেন, হারে তাতাই, তুই কি পাকাঁপাকি ভাবে দিল্লী ছেড়ে চলে এলি?
আমি মা-র কথার জবাব না দিয়ে ব্রীফ কেসের ভিতর থেকে অ্যাপোলোর খামটা বের করে বড়মার হাতে দিই। উনি সঙ্গে সঙ্গে খামের ভিতর থেকে চিঠিপত্র বের করে পড়তে পড়তেই চিৎকার করেন, শিবানী, শিগগির পড়ে দেখ।
অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পড়েই মা খুশি আর গর্বের হাসি হাসতে হাসতে বলেন, ওরে ভারতী, তাতাই পঁয়ত্রিশ হাজারে জীবন শুরু করবে আর আমরা। রিটায়ার করার আগেও এত মাইনে পাবার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না।
শিবানী, ভুলে যাচ্ছিস কেন তাতাই সোনা দু’দুবার প্রেসিডেন্টস গোল্ড মেডেল পেয়েছে। এর সঙ্গে আমাদের কেন, অনেকেরই তুলনা হয় না।
ভাইদার পর দুর্বা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পড়েই হাসতে হাসতে বলে, বয়ফ্রেন্ড, তোমাকে অ্যাপোলো গাড়ি দেবে, থাকার জন্য সাজানো গোছানো বাড়ি দেবে, তার উপর এত টাকা দিয়ে কী করবে?
ব্যাঙ্গালোরের সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে বাঁদরামী করে ওড়াব।
সে সাহস তোমার নেই।
ও না থেমেই বলে, যে আমার সঙ্গে.সহজভাবে মিশতে পারে না, সে আবার…
ওহে প্রেয়সী, আমি ভাইদার মত গোবেচারী গুড বয় না। তোমার মত আলতু-ফালতু মেয়ের দিকে আমার চোখ ফেরাতেও ইচ্ছা করে না।
জ্যেই এসে হাজির হওয়ার ঝগড়া জমল না। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দেখে জ্যেঠুও খুব খুশি। উনি মা-র দিকে তাকিয়ে বলেন, বৌমা, এবার থেকে আমরা মাঝে মাঝেই ব্যাঙ্গালোর যাবো।
হ্যাঁ, দাদা, নিশ্চয়ই যাব।
জ্যেঠু হাসতে হাসতে বলেন, বুঝলে বৌমা, তাতাই সোনার বাড়িতে থাকব খাবো, তাতাই সোনার গাড়ি চড়ব আর তাতাই সোনার টাকায় যাতায়াত করবো। ভাবতে পারো কি মজা হবে?
আমি বলি, জ্যেঠু, আপনারা যখন খুশি যাবেন; নো প্রবলেম কিন্তু যে ছেলে ছেলে বলে অভিনয় করে, শুধু সেই নটী বিনোদিনীকে এখানে রেখে যাবেন।
দুর্বা সঙ্গে সঙ্গে দু’হাত দিয়ে আমার দুটো কান ধরে বলে, মাই ডিয়ার বয় ফ্রেন্ড, আমি এক মাসের মধ্যে তোমার কাছে আসছি।
অসম্ভব।
অসম্ভব কেন?
সেই মহারাজার আমল থেকেই কসবার মেয়েদের ব্যানোর-মাইশোরে ঢুকতে দেওয়া হয় না।
আমার কথা শুনে সবাই হো হো করে হাসেন।
প্লেনেই খেয়ে এসেছি; তবু আমাকে জ্যেঠু আর ভাইদার সঙ্গে বসতে হলো একটু কিছু খাবার জন্য। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব মিটে যাবার পর জ্যেঠুর ঘরেই শুরু হলো আমাদের আড্ডা। আমি জ্যেঠুর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে শুয়েই কথাবার্তা শুনি, বলি। মাঝে মাঝে জ্যেঠু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
দুর্বা জ্যেঠুকে বলে, ছেলে, এই বুড়ো ধাড়ী তোমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়েছে কেন? তাছাড়া ওর মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে দেবারই বা দরকার কি?
জ্যেই না, আমিই ওর কথায় জবাব দিই। বলি, ওহে নটী বিনোদিনী, ভুলে যাও কেন আমি তাতাইসোনা? তাছাড়া জ্যেঠু আমার খামখেয়ালী ক্লাবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক।
তাই বলে আমার বুড়ো ছেলেকে তোমার সেবা করতে হবে?
না করে জ্যেঠু শান্তি পাবে নাকি?
হাসি-ঠাট্টার পর আমি বলি, জ্যেঠু, আমার একটা কথা আছে।
হ্যাঁ, বল।
মা আর বড়মা এবার কলেজের চাকরি ছেড়ে দিক।
জ্যেঠু কিছু বলার আগেই বড়মা বলেন, দ্যাখ তাতাই সোনা, সপ্তাহে দু’দিন কলেজে যাই বলেই আমাদের দুজনের শরীর ভাল আছে। কাজকর্ম না করে বাড়িতে বসে থাকলেই একটার পর একটা রোগ আমাদের ধরবেই।
মা সঙ্গে সঙ্গে বলেন, ভারতী, তুই ঠিক বলেছিস।
জ্যেঠু বলেন, হ্যাঁ, তাতাই সোনা, ওরা ঠিকই বলেছে। চুপচাপ বসে থাকলেই ওরা অসুস্থ হয়ে পড়বে।
আমি বলি, তার মানে আমার কাছে মা-বড়মার থাকা সম্ভব না।
দুর্বা বলে, বয়ফ্রেন্ড, কিছু চিন্তা করো না। আমি বছরে ছ’মাস এখানে থাকব; দু’মাস তোমার কাছে থাকব।
ওহে প্রেয়সী, তুমি থাকলে তো আমার ফ্ল্যাটের দেয়াল ছাদ সব ফেটে যাবে।
রাত প্রায় দেড়টা-পৌনে দুটো পর্যন্ত আড্ডা চলার পর আমি জ্যেঠুর বিছানাতেই ঘুমিয়ে পড়ি।