মিসেস তলোয়ার জবাব দেবার আগেই আমি বলি, ললিতা, তুমি জানো না, প্রফেসর রাও ঠিক করেছেন তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেন?
ও চাপা হাসি হেসে বলে, তাই নাকি?
ইয়েস, ললিতা, ইয়েস!
আমি না থেমেই বলি, আমি প্রফেসরকে কি বলেছি জানো?
কী বলেছ?
বলেছি, স্যার, ললিতা যখন ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, তখনই ও পুরনো বন্ধুর সঙ্গে রেজেস্ট্রি করেছে।
ললিতা সঙ্গে সঙ্গে পাশের ট্রে থেকে একটা ছুরি তুলে নিয়ে হাসতে হাসতে বলে, ডক্টর, আই উইল কিল ইউ।
মিসেস নায়ার বলেন, ললিতা, বেশি ন্যাকামো করিস না। তখন তোদের রেজেস্ট্রি না হলেও কিছুদিনের মধ্যেই তো…
ললিতা তাড়াতাড়ি ওর মুখ চেপে ধরে।
ললিতার ঠাট্টা-ইয়ার্কি বাদ দিলেও আমাকে নানাজনে বলে, প্রফেসর রাও তোকে গাধার মতো খাটাচ্ছেন।
তবে যে যাই বলুক, আমি বেশ বুঝতে পারছি, প্রফেসর রাও-এর কথামত কাজ করে আমার যথেষ্ট উপকার হচ্ছে। প্রত্যেক রুগীর সমস্যা আলাদা, প্রত্যেক অপারেশনও আলাদা। প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের রুগী দেখে আর অপারেশন করে আমার অভিজ্ঞতাও বাড়ছে। আস্থাও বাড়ছে। নিয়মিত বিভিন্ন জার্নাল পড়ে কত কি জানছি!
.
সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত আমি যেন নেশার ঘোরে কাটাই। এক মুহূর্তের জন্যও নিজের কথা ভাবার অবকাশ পাইনা কিন্তু রাত্রে শোবার পরে?
ঐ খাজুরাহোর সর্বনাশী আমার সামনে হাজির হয়। মুখে চাপা হাসি, চোখে বিদ্যুতের ছটা। আমি অজানা মন্ত্রশক্তিতে সব শক্তি হারিয়ে ফেলি। শুধু মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখি, ওর দেহের চড়াই-উতরাই, দেখি সর্বনাশা যৌবনের প্রলয়কারী নাচ। আমি চিৎকার করতে পারি না কিন্তু সহ্য করতেও পারি না। বার বার মনে হয়, পাগলের মত চিৎকার করে সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দিই, আমি দুর্বাকে, আমার প্রেয়সীকে চাই। ওকে না পাবার দুঃখ কষ্ট জ্বালা আমি সহ্য করতে পারছি না।
সমাজ-সংসারের নিয়ম কানুন বিধি নিষেধ যাই থাকুক, মানুষের মন তো মুক্ত বিহঙ্গ। সে শরতের নীল আকাশে টুকরো টুকরো সাদা মেঘের মত স্বচ্ছন্দে মনের মহাকাশে বিচরণ করে।
শুক্লা ত্রয়োদশীর এই রাত্রে আমার শরীর যেন আরো একটা শরীর খোঁজে অনাস্বাদিত আনন্দ আর উষ্ণতার জন্য কিন্তু কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে।
এইভাবেই কেটে গেল প্রায় পাঁচ মাস।
সেদিন শনিবার। প্রফেসর রাও আমাকে বললেন, কাল সকালে একবার আমার ওখানে এসো।
হ্যাঁ, স্যার, আসব।
রবিবার সকাল ন’টা নাগাদ আমি প্রফেসরের কোয়ার্টারে গেলাম।
শুভ, প্লীজ সীট ডাউন।
আমি সামনের একটা চেয়ারে বসতেই উনি বললেন, আমি চাইনি তুমি যেখানে-সেখানে চাকরি করে মোটা মাইনে পাও। যাইহোক আমার এক প্রিয় ছাত্র মাথাই ব্যাঙ্গালোর অ্যাপোলোর সার্জারি ডিপার্টমেন্টের হেড। ও দিন দশেক আগে একটা জরুরী কাজে দিল্লী এসে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল।
আমি মন দিয়ে প্রফেসরের কথা শুনি।
প্রফেসর বলে যান, মাথাই-এর সঙ্গে তোমার বিষয়ে অনেক কথা হলো। তোমাকে সহকর্মী হিসেবে পেতে ও খুবই আগ্রহী। শুধু তাই না; ও কথা দিয়েছে, তোমাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতেও দেবে।
আমি একটু হাসি।
উনি একটা খাম আমার হাতে দিয়ে বলেন, মাথাই ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কথা বলে তোমার এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাঠিয়েছে। ওরা শুধু ভাল মাইনেই দেবে না; তোমাকে ফার্নিস কোয়ার্টর আর বিনা সুদে গাড়ি কেনার টাকাও দেবে। তাছাড়া গাড়ির খরচ বাবদ মাসে মাসে কয়েক হাজার টাকা দেবে।
স্যার, আমি কি এত পাবার যোগ্য?
অ্যাপোলো তো রামকৃষ্ণ মিশন না যে বিনা স্বার্থে মানুষের উপকার করবে?
ওনার মন্তব্য শুনে আমি না হেসে পারি না।
প্রফেসর একবার নিঃশ্বাস নিয়েই বলেন, দিন দশেক পরই তোমাকে জয়েন করতে হবে; তবে জয়েন করার দু’একদিন আগে পৌঁছনোই ভাল।
হ্যাঁ, স্যার, তাই করবো।
কাল-পরশু কলকাতা যাও। সেখানে ক’দিন কাটিয়ে ব্যাঙ্গালোর যেও।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমেই বলেন,ঐ খামের মধ্যেই দিল্লী-কলকাতা ব্যাঙ্গালোরের এয়ার টিকিটও ওরা পাঠিয়েছে।
আমি একটু জোরেই হেসে উঠে বলি, স্যার, আপনি আর কিছু ব্যবস্থা করেন নি?
আমি আবার কি ব্যবস্থা করবো?
কফি খাবার সময় প্রফেসর বলেন, বছরে অন্তত দুবার আমার কাছে এসে কয়েকদিন কাটিয়ে যেও।
স্যার, আমি নিশ্চয়ই আসব।
আর হ্যাঁ, মাথাই বলছিল, তোমাদের ব্যাচের একজন মাস তিনেক আগে ওখানে জয়েন করেছে। ভালই হলো কি বলো?
হ্যাঁ, স্যার, আমাদের ব্যাচের কাউকে ওখানে পেলে আমার অনেক উপকার হবে।
আমি প্রণাম করতেই উনি বলেন, যাও, মন দিয়ে কাজ করো। কয়েক বছরের মধ্যেই তোমার খ্যাতি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বেই।
আমি আবার ওনাকে প্রণাম করে বিদায় নিই।
.
হঠাৎ দিল্লী ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবেই মন বিষণ্ণতায় ভরে গেল। দু’এক বছর না, দীর্ঘ সাত আট বছরের নিবিড় সম্পর্ক হস্টেলের এই ঘরের সঙ্গে। তাছাড়া হস্টেলের প্রত্যেক কর্মীর সঙ্গেও আমার মধুর সম্পর্ক। বছরের পর বছর ওরা আমার দেখাশুনা না করলৈ কি পড়াশুনা করতে পারতাম? তাছাড়া ইনস্টিটিউটে কতজনের সঙ্গে আমার প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এদের সবার সঙ্গে দেখা না করে ইভনিং ফ্লাইটে বুকিং করেই ভাইদাকে অফিসে ফোন করে সব খবর জানালাম।
ভাইয়া, আমি সোজা অফিস থেকে এয়ারপোর্টে যাবো। তুই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যাবি না।