ওনার কথায় সুনন্দা না হেসে পারেন না।
দুর্বা হাসতে হাসতে শিবানীকে বলে, মাসীমা, আপনি কোন ছেলের হয়ে আমাকে দেখতে বা পরীক্ষা নিতে আসেন নি তো?
এইসব গোপনকথা তোমাকে বলব কেন?
যাইহোক আরো প্রায় ঘণ্টা দুয়েক গল্পগুজব, হাসি ঠাট্টা, খাওয়া-দাওয়ার পর—
সুনন্দা, তুমি ময়নাকে নিয়ে কবে আমাদের ওখানে আসছো?
ভারতীদি, এখন ময়না একদিন তোমাদের ওখান থেকে ঘুরে আসুক। ময়নার বাবা ফিরলে আমি নিশ্চয়ই যাব।
ঠিক তো?
হ্যাঁ, ভারতীদি, সত্যি আমি যাব।
শিবানী বলেন, ভারতী, তোমার মেয়েকে কিন্তু আমাদের ওখানে সারাদিন কাটাতে হবে। সন্ধ্যের পর আমরাই ওকে পৌঁছে দিয়ে যাব।
না, না, তার দরকার হবে না।
দুর্বা একটু হেসে বলে, মাসীমা, আমার দুই বন্ধু সল্টলেকে থাকে। আমি তো একলাই ওদের ওখানে যাতায়াত করি।
ভারতী বলেন, দুর্বা, তুমি কবে যাবে আমাদের ওখানে?
আমি তো এখন বেকার। যেদিন বলবেন, সেইদিনই যেতে পারি কিন্তু উইক ডে-তে তো আপনাদের কলেজ আছে।
সে চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। তুমি পরশু যেতে পারবে?
হ্যাঁ, পারবো।
তাহলে ঠিক ন’টার মধ্যে আমি বা শিবানী এসে তোমাকে নিয়ে যাব।
মাসীমা, প্লীজ, আপনাদের কাউকে…
প্লীজ ডোন্ট আর্গু দুর্বা! আমি বা শিবানী এসে তোমাকে নিয়ে যাব, দ্যাটস ফাইন্যাল।
দুর্বা শুধু হাসে।
ওরা দুজনেই সুনন্দার দুটি হাত ধরে বলেন, তোমাদের কাছে এসে সত্যি খুব আনন্দ পেলাম।
তোমাদেরও আমার খুব ভাল লেগেছে।
দুর্বাকে দু’জনেই বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে আদর করলেন, স্নেহচুম্বন দিলেন কপালে।
দুর্বাও ওদের প্রণাম করে।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে একটু এগুতে না এগুতেই ভারতী এক গাল হেসে বলেন, হ্যাঁরে শিবানী, কেমন লাগলো দুর্বাকে?
এত ভাল লেগেছে যে মুখে বলতে পারব না। তুই ঠিকই বলেছিলি; সত্যি মনে হলো, ঈশ্বর যেন নিজের হাতে খোদাই করে ওকে গড়েছেন।
০২. শিবানীর সঙ্গে পরামর্শ করে
শিবানীর সঙ্গে পরামর্শ করেই ভারতী ঠিক করেছিলেন, আরো কিছুদিন না গেলে স্বামী বা ছেলেকে কিছু জানাবেন না। ওরা যাতে কোনকিছু জানতে না পারে, সেজন্য খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও হয়েছিল শিবানীর বাড়িতে।
তবে হ্যাঁ, ভারতী নিশ্চয়ই দুর্বাকে নিজের বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাবেন।
দুই বন্ধু আলাপ-আলোচনা করেই ঠিক করেছিলেন, বাবাই বা ওর বাবা বাড়ি ফেরার আগেই ওরা দুর্বাকে নিয়ে রওনা হয়ে যাবেন।
সেদিন শিবানী ট্যাক্সি নিয়ে হাজির হতেই দুর্বা হাসতে হাসতে বেরিয়ে এসে বলল, মাসীমা, আমি রেডি চটি বদলেই আসছি।
সুনন্দাও বেরিয়ে এলেন। বলেন, একি, তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে কেন?
না, ভাই সুনন্দা, এখন আর বসব না।
তাই বলে, একেবারে দরজা থেকেই চলে যাবে?
ঠিক সেই সময় দুর্বা বেরিয়ে এসে বলল, মা, আসছি।
শিবানী একটু হেসে বলেন, সুনন্দা, চিন্তা করো না। তোমার মেয়েকে ঠিক সময়েই ফিরিয়ে দিয়ে যাবে।
তোমাদের ওখানে যাচ্ছে, চিন্তা করব কেন?
শিবানী আর দুর্বা ট্যাক্সিতে উঠে বসতেই সুনন্দা হাসতে হাসতে বলেন, শিবানী, ঘটকালি করার ব্যাপারটা ভুলে যেও না।
উনিও হাসতে হাসতে বলেন, মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। সে দায়িত্ব তো আমি স্বেচ্ছায় নিজের হাতে তুলে নিয়েছি।
বাইপাস দিয়ে ট্যাক্সি ছুটছে। কিছু কুন্তল রাশি উড়ে পড়ছে দুর্বার মুখে কিন্তু সেদিকে ওর হৃক্ষেপ নেই। খোলা জানলা দিয়ে দুরের আকাশ দেখতে দেখতেই ও একটু হেসে বলে, জানেন মাসীমা, আমার খুব ইচ্ছে করে গাড়ি নিয়ে সারা দেশ ঘুরে বেড়াতে আর প্রাণভরে প্রকৃতি দেখতে।
ও সঙ্গে সঙ্গে একটু চাপা গলায় গেয়ে ওঠে–
আকাশে আজ কোন্ চরণের
আসা-যাওয়া
বাতাসে আজ কোন্ পরশের
লাগে হাওয়া…।
শিবানী অপলক দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বলেন, শিল্পী, তোমাকে যত দেখছি, তত বেশি ভাল লাগছে।
দুর্বা চাপা হাসি হেসে বলে, আপনি কি সত্যি সত্যিই আমার নাম রাখলেন শিল্পী?
তোমাকে তো আর লেন নামে ডাকা যায় না।
.
ট্যাক্সি থামার আওয়াজ শুনেই ভারতী ভিতর থেকে বেরিয়ে আসেন। দুর্বা ট্যাক্সি থেকে নামতেই উনি ওকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তোমার মুখোনা দেখার জন্য কখন থেকে হা করে জানলার ধারে বসে আছি।
শিবানী, ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়েই ওদের দুজনের হাতে ধরে বলেন, এখন ভিতরে চলল তো।
ড্রইং রুমে পা দিয়েই সামনের ছবিটা দেখে দুর্বা বলে, মাসীমা,এই ভদ্রলোকের ছবিতে মালা দেওয়া কেন? আজ কী ওনার জন্মদিন?
শিবানী একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, না, শিল্পী, আজ ওনার জন্মদিন না। আমি রোজই এই ছবিতে মালা দিই।
কেন?
দুর্বা যেন জিভ ফসকে প্রশ্ন করে।
ভারতীও একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, দুর্বা, আমার এই দেওর বহুঁকাল আগেই আমাদের সবাইকে ফেলে চলে গেছে।
ছবি দেখে তো মনে হচ্ছে, উনি নেহাতই ইয়ং ম্যান। উনি কবে মারা গিয়েছেন?
ভারতীই ওর প্রশ্নের জবাব দেন, ঠাকুরপো মারা যাবার ঠিক দশ দিন আগে এই ছবিটা তোলা হয়।
ও মাই গড! এত অল্প বয়সে…
শিবানী ওর একটা হাত ধরে বলেন, এখন ভিতরে চলল। পরে সবই জানতে পারবে।
হঠাৎ যেন সুর কেটে যায়, ছন্দ পতন হয়। হাসি উবে যায় তিনজনেরই মুখ থেকে।
দুর্বা যেন নড়তে পারে না। অপলক দৃষ্টিতে আবার ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত। তারপর খুব আস্তে গেয়ে ওঠে–