কাবেরী সঙ্গে সঙ্গে এক হাত দিয়ে আমার মুখোনা ওর দিকে ঘুরিয়ে বলে, ভাইয়া, আমি আর মেজদি তোমার পাশে শুয়েছি বলে তোমার খারাপ লাগছে?
না, না খারাপ লাগছে না।
গঙ্গা বলে, ভাইয়া, তুমি প্লীজ স্বাভাবিক হয়ে শোও। তা না হলে আমার খারাপ লাগছে।
আমি দুটো হাত ওদের মাথায় রেখে বলি, আমার তো কোন ছোট বোন নেই; তাই অভ্যাস নেই। তবে আজ তোমাদের দুজনকে দুপাশে পেয়ে আমার সত্যি খুব ভাল লাগছে।
এর পর আমি সত্যি একটু স্বাভাবিক হয়ে শুই কিন্তু সতর্ক না হয়ে পারি না।
যাই হোক আস্তে আস্তে জমে ওঠে আমাদের গল্পগুজব। কি ভাবে যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়, তা আমরা কেউই টের পাই না। হঠাৎ একবার টর্চ জ্বালিয়ে ঘড়ি দেখেই বিপাশা হাসতে হাসতে বলে, শুভ, আড়াইটে বাজে।
গঙ্গা সঙ্গে সঙ্গে বলে, বাজুক ভাইদার ঘুম পায়নি।
তাই নাকি?
ইয়েস মাই ডিয়ার দিদি! ভাইদার সত্যি ঘুম পায়নি।
তোরা কি ওকে সারা রাত্তির ঘুমোতে দিবি না?
আমি বলি, বিপাশা, তুমি ঘুমোও। আমি আর একটু ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেই ঘুমোব।
শুভ, আমি ঘুমোচ্ছি। বড্ড ঘুম পাচ্ছে। তুমি কিছু মনে করো না।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি ঘুমোও। আমি কিছু মনে করবো না।
বিপাশা বোধহয় চোখ বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ে, মিনিট দশেকের মধ্যে কাবেরীও ঘুমিয়ে পড়ে। ওদের দু’জন ঘুমিয়ে পড়ায় গঙ্গা মহা খুশি। এক গাল হেসে বলে, ভাইয়া, এবার তুমি আমার দিকে পাশ ফিরে শোও।
হ্যাঁ, আমি ওর দিকে পাশ ফিরে শুয়েই বলি, তোমার ঘুম পাচ্ছে না?
না।
কেন?
তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ, আমাদের মধ্যে দৈন্যও নেই, দুঃখও নেই; আমরা পাঁচজনেই খুব সুখী কিন্তু আমাদের কোন ভাই নেই বলে আমরা সবাই এত বছর ধরে একটা বিচিত্র শূন্যতাবোধ করেছি।
তা তো খুবই স্বাভাবিক।
আজ মা ছেলে পেয়েছে, আমরা ভাইয়া পেয়েছি। এমন আনন্দের দিনে কি ঘুম আসে?
আমি আলতো করে ওর মুখের উপর হাত রেখে বলি, গঙ্গা, আমিও এত বছর ধরে যে শূন্যতা, যে অভাববোধ করেছি, তা তোমাদের পেয়ে চলে গেল।
একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, আজ আমারও পরম আনন্দের দিন।
গঙ্গাও আমার মুখের উপর একটা হাত রেখে বলে, মা কি বলছিলেন জানো?
কি বলছিলেন?
বলছিলেন, শুভব্রতর মত ছেলে পেয়ে আমার বল-ভরসা হাজার গুণ বেড়ে গেল। এখন যে সমস্যাই আসুক, আমার ছেলেই সব সামলে নেবে।
হ্যাঁ, গঙ্গা, আমি সারাজীবন তোমাদের পাশে থাকব। সে বিশ্বাস, সে আস্থা আমাদের আছে।
.
আমার ডায়েরীর পাতায় ওরা বার বার ফিরে এসেছে। ফাইন্যাল এম. বি. বি. এস. পরীক্ষার পর ওদের তিন বোনকে নিয়ে কলকাতা যাবার কাহিনী, ওদের তিনজনকে কাছে পেয়ে মা-বড়মা আর জ্যেঠু-ভাইদার আনন্দে খুশিতে মেতে ওঠার কথা, ওদের তিনজনের পাল্লায় পড়ে ওদের সঙ্গেই মা-বড়মার কাশী যাওয়ার বৃত্তান্তে ভরে গেছে পাতার পর পাতা।
বিপাশাদের পরিবারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা অভাবনীয় না হলেও অপ্রত্যাশিত,। পৃথিবীতে অনেকেই অপ্রত্যাশিত ভাবে পেয়ে যায় আপনজনের সান্নিধ্য, স্নেহ মমতা-ভালবাসা। কিন্তু আজ যা লিখতে বসেছি, তা যেমন অপ্রত্যাশিত, সেইরকমই অভাবনীয়। আমি কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি, এমন একজনের সাক্ষাৎ ও সান্নিধ্য পাবো; আমি ভাবতে পারিনি, আমার এত বছরের সযত্নে লালিত পালিত চিন্তা-ভাবনা-আদর্শ-দৃষ্টিভঙ্গী কয়েকটি অবিস্মরণীয় মুহূর্তের মধ্যে বদলে যাবে।
ফাইন্যাল এম. এস. পরীক্ষার পর কলকাতা গেলাম আমার প্রিয়তম চারটি মানুষের সান্নিধ্যে আনলে কয়েকটি দিন কাটাবার জন্য। আমি যত উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে গিয়েছিলাম, বড়মার কাছে ভাইদার বিয়ের খবর শুনে আমি ঠিক তত দুঃখ ও আঘাত পেলাম। ভীষণ রাগও হলো। কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, আমি তখনই আবার এয়ারপোর্টে ফিরে যাই পরবর্তী ফ্লাইটে দিল্লীতে আসার জন্য। না, তা পারলাম না। মা-বড়মা-জ্যেই-ভাইদাকে কোন রকম দুঃখ বা আঘাত দেবার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। পারলাম না। বড়মা জ্যেঠুকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদেছি কিন্তু ওদেরই বুকের উপর মুখ রেখে সব দুঃখ ভুলেছি।
এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল কিন্তু যে মুহূর্তে ভাইদার স্ত্রীর রূপ-গুণের কথা শুনলাম, আমি নিজেকে সংযত রাখতে পারি না। আমি দপ করে জ্বলে উঠি। আমি চিৎকার করে বড়মাকে বলি, আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু সী হার ফেস!
তারপর?
ভাইদার স্ত্রী আমার ঘরে ঢুকে আমার চোখের উপর চোখ রেখে বলল, তাতাই, আসামী হাজির। আমাকে কি শাস্তি দেবে দাও।
আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে অপলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। মুহূর্তে মনে হলো, খাজুরাহোর সব চাইতে অপরূপ, সব চাইতে মোহময়ী, সব চাইতে উত্তেজক নারী মূর্তি হঠাৎ আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
আর আমি?
ঠিক মর্মর মূর্তির মত আমি একই রকম অপলক দৃষ্টিতে রূপ-মুগ্ধ, মোহগ্রস্থ, কামনায় জর্জরিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।
ও আরো কত কি বলে কিন্তু আমি শুনতে পাই না। শুনব কী করে? আমার অনেক ইন্দ্রিয়ই যে অবশ হয়ে গেছে। আমার শিরা-উপশিরার মধ্যে দিয়ে তখন অশান্ত দুর্বিনত এক পাগলা ঘোড়া ছুটছে।
দিল্লীতে ডাক্তারী পড়তে গিয়ে কত সুন্দরী যুবতীকে দেখলাম, তাদের অনেকের সঙ্গেই মেলামেশা করলাম কিন্তু কেউ আমাকে এভাবে পাগল করেনি।