আমিও একটু হেসে বলি, আমাকে না দেখেই এত ভালবেসে ফেলেছেন!
কি করব বাবা!
উনি একবার নিঃশ্বাস নিয়েই বলেন, এই যে বাবা বিশ্বনাথের মাথায় প্রতিদিন জল ঢেলে আসি কিন্তু তাকে তো দেখার সৌভাগ্য হয়নি। শুধু তার কথা জেনেই তাকে ভক্তি করি, পুজো করি।
আরতি দেবী সঙ্গে সঙ্গেই একটু হেসে বলেন, তাহলে তোমার কথা জানার পর তোমাকে কেন ছেলে মনে করবো না?
গঙ্গা দু’হাতে দু’কাপ চা নিয়ে আমাদের পাশে এসে বলে, ও মা, পরে ছেলেকে আদর করো এখন ভাইয়াকে চা খেতে দাও।
এইভাবেই হলো শুরু।
সাড়ে ন’টার আগেই বিপাশার বাবা অফিসে রওনা হলেন। বেরুবার আগে উনি আমাকে বললেন, আফিস থেকে ফিরে আসার পর তোমার সঙ্গে গল্প করবো।
তারপর আমাদের পাঁচজনের কত কথা কত গল্প। চা খেতে খেতে গল্প, রান্না করার সময় গল্প, দুপুরে সবাই মিলে বারান্দায় খেতে বসেও গল্প।
না, তাতেও যেন কথা ফুরোয় না। সারা দুপুর কত কথা, কত হাসি।
সকালে জলখাবার খেতে খেতেই আমি আরতি দেবীকে বললাম, আপনি তো জানেন, আমার মা আছেন, বড়মা আছেন।
উনি একটু হেসে বলেন, হ্যাঁ, বিপাশা সব জানিয়েছে।
তাই আমি আপনাকে ছোট মা বলব। আপনার আপত্তি নেই তো?
না, বাবা, কোন আপত্তি নেই।
বিপাশা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে, শুভ, তোমাকে কি গঙ্গার হায়ার সেকেন্ডারীর রেজাল্টের ডিটেলস্ বলেছি?
তুমি শুধু বলেছিলে, ও ফার্স্ট ডিডিসন পাশ করেছে।
তুমি শুনলে অবাক হয়ে যাবে গঙ্গা শুধু ফার্স্ট ডিভিসনে পাশ করেনি, ও ও ফিজিক্স-কেমিস্ত্রী আর ম্যাথ-এ হাইয়েস্ট নম্বর পেয়েছে।
আমি কোন মন্তব্য করার আগেই কাবেরী গলা চড়িয়ে বলে, ভাইয়া, মেজদি সমস্ত ইউ-পি’র মধ্যে এই রেকর্ড করেছে।
গঙ্গা আমার আমার বাঁ দিকেই বসেছিল। আমি বাঁ হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে একটু কাছে টেনে নিয়ে বলি, সারাজীবন তোমাকে এইভাবে জয়ী হয়ে মা বাবার মুখে হাসি ফোঁটাতে হবে।
ও মুহূর্তের জন্য আমার দিকে তাকিয়েই মুখ নীচু করে বলে, আমরা তিন বোনেই সব সময় সেই চেষ্টা করি।
তা আমি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছি।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর মেয়েদের ঘরেই আমাদের আড্ডার আসর বসলো। একটা তক্তাপোষে বিপাশা আর ওর মা, অন্য তক্তাপোষে আমি আর অন্য দুই মেয়ে।
বিকেলের দিকে বিপাশা আমাকে বলে, শুভ, তুমি কি এখানকার গঙ্গায় নৌকা চড়েছে?
না।
তাহলে তুমি গঙ্গা আর কাবেরীকে নিয়ে নৌকা চড়ে এসে খুব ভাল লাগবে। আমিও ভাবছিলাম, একটু ঘুরে আসি।
.
চা খেয়েই আমরা তিনজনে বেরিয়ে পড়লাম। সত্যি, নৌকায় চড়ে ঘাটগুলি দেখতে দেখতে কত কি মনে হলো। মনে হলো, যুগ-যুগান্তর ধরে ভারতবর্ষের মানুষ দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনা সাফল্য-ব্যর্থতা ভুলে আত্মার মুক্তি সাধনায় নিজেদের মগ্ন রাখতে জানে। এটাই ভারতবর্ষের চিরন্তন রূপ। গঙ্গার বুকে নৌকায় বসে বসে অসংখ্য মন্দিরের সন্ধ্যারতির কাসর-ঘণ্টার আওয়াজ শুনলাম। তারপর শেষ হয় আমাদের নৌকা বিহার।
বাড়ি ফেরার পথে গঙ্গা আর কাবেরী দু’জনেই বলল, ভাইয়া, এখনই বলে দিচ্ছি, রাত্রে তোমাকে একা শুতে দেব না। আমরা দুজনে দু’পাশে সোব।
আমি একটু হেসে বলি, একটা খাটে কি তিনজনে শুতে পারবো?
ওরা দু’জনে একসঙ্গে বলে, দুটো খাট জোড়া দেব।
বাড়ি ফিরেই কাবেরী সগর্বে ঘোষণা করে, রাত্রে আমরা দুজনে ভাইয়ার দু’পাশে শোবো।
বিপাশা একটু হেসে বলে, আমি কোথায় শোবো?
গঙ্গা সঙ্গে সঙ্গে জবার দেয়, তুমি মা-র কাছে শোবে।
ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এসে বিশ্বনাথবাবু এক গাল হেসে বলেন, দেখছে শুভব্রত, তোমাকে পেয়ে তোমার বোনেরা কি দারুণ একসাইটেড?
ওদের কাছে পেয়ে আমিও খুব একসাইটেড।
মুহূর্তের জন্য থেমে বলি, আমি তো জীবনে কোনদিন এই আনন্দ পাইনি, তাই খুব ভাল লাগছে।
বিপাশা দুটো আসন পেতে বলে, তোমরা বসে কথা বলল।
হ্যাঁ, আমরা দুজনে মুখোমুখি বসতেই বিশ্বনাথবাবু বলেন, সারাদিন কেমন কাটালে?
খুব ভাল।
খুব ভাল কেন?
আমি একটু হেসে বলি, এমন আন্তরিকতা আর প্রাণ ঢালা ভালবাসা পেয়েও ভাল থাকব না?
হ্যাঁ, শুভব্রত, আমাদের সংসারে আন্তরিকতা আর ভালবাসার কোন অভাব নেই।
মনের দুর্বলতা থেকেই তো অভাব বোধের জন্ম।
তুমি ঠিকই বলেছ কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে লোভ থেকেও অভাববোধ জন্মায়।
আপনি ঠিকই বলেছেন; যে লোভী, তাকে কোনভাবেই খুশি করা যায় না।
আরো কত কথা হয় আমাদের। মাঝে মাঝেই যোগ দেন আরতি দেবী। আলোচনা চলল খাবার সময় পর্যন্ত।
রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার সময় বিপাশা অন্য দুই বোনকে বলে, তোরা দু’জনে শুভ’র সঙ্গে জমিয়ে গল্প করবি আর আমি বুঝি ভাল মেয়ে হয়ে মা-র কাছে। শুয়ে থাকব?
কাবেরী চাপা হাসি হেসে বলে, দিদি, তুই বরং আমাদের সঙ্গে ঘণ্টা খানেক গল্পগুজব করে শুতে যাস।
ইস! তুই কী উদার!
বিপাশা বলে, আমিও তোদের ঘরেই শোবো।
শেষ পর্যন্ত আমরা চারজনেই ঐ ঘরে শুই। তবে গঙ্গা আর কাবেরীকে দু’পাশে নিয়ে শুতে খুবই অশ্বস্তিবোধ করি। গঙ্গা কুড়ি বছরের যুবতী; কাবেরীও নেহাত ছোট না। ওর বয়স সতের। আমি ওদের দুজনের মাঝখানে প্রায় কাঠের মতো শুয়ে থাকি।
ওরা দু’জনে আমার অবস্থা না বুঝলেও বিপাশা ঠিকই বুঝতে পারে। ও একটু হেসে বলে, শুভ, গঙ্গা আর কাবেরী তোমার চাইতে অনেক ছোট। তোমার অস্বস্তিবোধ করার কোন কারণ নেই।