মাস খানেকের মধ্যে অন্তত পাঁচ-ছ’ দিন সবাই চলে যাবার পর আমি আর বিপাশা ডিসেকশান রুম থেকে রেরোই।
সেদিন ডিসেকশান হল থেকে বেরুতেই আমাদের ব্যাচের আট দশজন ছেলে মেয়ে আমাদের ঘিরে ধরলো। সবার মুখেই অর্থপূর্ণ হাসি সবার চোখেই কৌতুক-দৃষ্টি।
বাসুদেব কুলকার্নি হাসতে হাসতে বলে, তোদর তান্ত্রিক সাধনা কেমন হলো?
বিপাশা চাপা হাসি হেসে ডান হাত দিয়ে ওর গাল টিপে বলল, বাসুদেব, রিয়েলী ইট ওয়াজ ওয়ান্ডারফুল।
ও এক নিঃশ্বাসেই বলে, আর ইউ হ্যাপি?
আই উইল বী হ্যাপি যদি আমাদের খাইয়ে দাও।
ওর মুখের কথা ফুরুতে না ফুরুতেই বিপাশা ওর গালে একটা চড় মেরে বলে, আরো খাবি?
বাসুদেবও সঙ্গে সঙ্গে ওকে চড় মারতে যায় কিন্তু বিপাশা ঝড়ের বেগে সরে যায়।
সবাই হো হো করে হেসে ওঠে।
কিছুদিন আমাকে আর বিপাশাকে নিয়ে দু’চারজন কিছুদিন হাসি-ঠাট্টা করলেও আস্তে আস্তে সবাই বুঝেছিল, আমরা নিছকই বন্ধু। এই বন্ধুত্ব দিন দিন আরো গভীর, আরো মধুর হয়েছে। দিল্লীতে যাবার পর বিপাশাই আমার হাতে প্রথম রাখী পরায়।
তখন আমরা থার্ড ইয়ারে উঠেছি। কফি খেতে খেতে আমি বিপাশাকে বলি, তুমি কী হতে চাও? গাইনি? পিডিয়াটিশিয়ান, জেনারেল প্রাকটিশানার…
ও একটু হেসে বলে, ব্যস! ব্যস! আর এগিয়ো না। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর বিপাশা একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, শুভ, অন্য কাউকে বলিনি, বলতে পারবও না কিন্তু তোমাকে বলতে দ্বিধা নেই যে আমার বাবা অতি সাধারণ সরকারী চাকুরে।
আমি জিজ্ঞাস দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাতেই ও একটু ম্লান হেসে বলে, হি ইজ যাস্ট অ্যা আপার ডিভিশন ক্লার্ক।…
তোমার বাবা কোথায় কাজ করেন?
বেনারসের জেলা জজের অফিসে।
বিপাশা একটু থেমে বলে, আমরা তিন বোন; কোন ভাই নেই। তাছাড়া আমার মা-র কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয়েছে।…
আই সী।
বাবার আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ। সংসার চালানো ছাড়াও মা-র জন্য প্রতি মাসে যথেষ্ট খরচ করতে হয়। লাখ লাখ টাকা খরচ করে মেয়েদের বিয়ে দেবার ক্ষমতা নেই বলেই বাবা আমাদের পড়াচ্ছেন।
তুমি কি এম. বি. বি. এস. পাশ করেই চাকরি করবে নাকি…
চাকরি করতেই হবে।
বিপাশা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, বাবাকে সাহায্য করতে না পারা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। তাছাড়া মা-র চিকিৎসা আর ছোট বোনদের দায়িত্ব তো আমাকেই নিতে হবে।
দিন দিন বিপাশার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। কখনো কখনো ও আমার কথা জানতে চায়, জানতে চায় বাবার মৃত্যুর কথা, মা-বড়মার কথা, জ্যেঠু আর ভাইদার কথা।
এইসব সোনার পর বিপাশাও কত কথা বলে।
শুভ, তোমার বাবার মৃত্যুর কথা যখনই মনে হয়, তখনই মন খারাপ হয়ে যায়। তুমি তোমার বাবাকে এক মুহূর্তের জন্যও দেখতে পাওনি ভাবলেই আমার চোখে জল আসে। নিঃসন্দেহে তোমার জীবনের অর্ধেক অন্ধকার।
আমি কোন কথা বলি না; চুপ করে থাকি।
বিপাশা আমার একটা হাত ওর দুটো হাতের মধ্যে নিয়ে দু’এক মিনিট চুপ করে থাকার পর বলে, আবার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হয়, একদিক দিয়ে তোমার মা আর তোমার মত ভাগ্যবান খুব বেশি দেখা যায় না।
ও মুহূর্তের জন্য থেমে বলে, অমন জ্যেঠু, বড়মা আর ভাইদা পাওয়া সত্যি অভাবনীয় সৌভাগ্যের ব্যাপার।
আমি একটু হেসে বলি, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বিপাশা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, তাছাড়া অমন দাদা, বন্ধুও বোন আর বাবাইসোনা পেয়েছিলেন বলেই তোমার মা স্বামীকে হারাবার দুঃখ সহ্য করতে পেরেছেন।
হ্যাঁ, বিপাশা তুমি ঠিকই বলেছ।
সময় ও সুযোগ হলে আমরা আরো কত কথা বলি।
একদিন একটা ক্লাশ শেষ হতেই বিপাশা ইসারায় আমাকে ডাক দেয়। তারপর করিডরের এক কোনায় গিয়ে বলে, শুভ, তোমাকে একটা কথা বলব; কিছু মনে করবে না তো?
কি আবার মনে করব? বলো, বললো, কি বলতে চাও।
কাল রাত্তিরে বাবা হস্টেলে ফোন করেছিলেন।
ফোন করেছিলেন কেন?
বাবা বললেন, এখুনি টাকা পাঠাতে পারছেন না কিছুদিন দেরি হবে।
ও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, এদিকে পরশুর মধ্যেই হস্টেলে টাকা দিতে হবে। তুমি কি আমাকে…।
ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আমি একটু হেসে বলি, বিপাশা, ভুলে যেও না, তুমি আমার হাতে রাখী পরাও ইউ আর মাই সিস্টার।
আমি না থেমেই বলি, তুমি কোন ফি করো না। আমি আজই ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে রাখবো। তুমি কাল হস্টেলে টাকা দিয়ে দিও।
তোমার কোন অসুবিধে হবে না তো?
না, না, কোন অসুবিধে হবে না।
আমি সঙ্গে সঙ্গেই আবার একটু হেসে বলি, আমি জন্মাবার পর পরই মা আমার হায়ার এডুকেশনের জন্য যে ইন্সিওর করেন; তার পুরো টাকাই আমার ব্যাঙ্কে আছে। তাছাড়া মা আর জ্যেঠু প্রত্যেক মাসেই বেশ কিছু টাকা ব্যাঙ্কে জমা করেন।
বিপাশা একটু হেসে বলে, তার মানে তুমি বেশ মোটা টাকার মালিক।
দ্যাটস রাইট।
আমি এক নিঃশ্বাসেই বলি, সেইজন্যেই তো বললাম তোমার কোন চিন্তা নেই।
তোমার কথা শুনে খুব নিশ্চিন্ত হলাম। বাবা টাকা পাঠালেই আমি তোমাকে দিয়ে দেব।
হ্যাঁ, টাকা ফেরত দিও কিন্তু আর কোনদিন আমার হাতে রাখী পরাতে পারবে না।
কি আশ্চর্য।
কিছু আশ্চর্যের ব্যাপার না। রাখী পরাবে আবার ধার-দেনার সম্পর্ক গড়ে তুলবে, তা হয় না।
বিপাশা মুগ্ধ বিস্ময়ে আমার দিকে তাকায়। কোন কথা বলে না।