বলো কি ভাইদা?
আজ কলকাতার সব কাগজের প্রথম পাতার প্রধান খবর তুই; অনেক ছবিও ছাপা হয়েছে।
তার মানে কলকাতার লোক খুশি?
ভারতী বলেন, খুশি কিরে! আনন্দে গর্বে সবাই ভেসে যাচ্ছে।
সুব্রতবাবু প্রশ্ন করেন, হারে, তাতাই সোনা, দিল্লির কাগজে তোর খবর ভাল করে ছেপেছে?
হ্যাঁ, দিল্লির সব কাগজেই প্রথম পাতায় আমার ছবি দিয়ে খবর ছেপেছে।
শিবানী বলেন, ওরে, তুই দু’একদিনের জন্য আমাদের কাছে আসবি না?
আসব তো নিশ্চয়ই; তবে কবে আসব, তা এখনই বলতে পারছি না।
দুর্বা বলে, বয়ফ্রেন্ড, প্লীজ তাড়াতাড়ি এসো; আমরা আর ধৈর্য ধরতে পারছি না।
প্রেয়সী, আমি কলকাতায় এসেই তোমাকে নিয়ে সোজা সুইজারল্যান্ড যাবো।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, এসো; আমি রেডি।
ভাইদা হাউ হাউ করে কান্নাকাটি করবে না তো?
ও যা ইচ্ছে করুক; আমরা চলে যাবো।
না, প্রেয়সী, তা হয় না। আমরা সুইজারল্যান্ড গেলে ভাইদাকে ধেই ধেই করে নাচতে হবে।
ওর কথা শুনে সবাই হেসে ওঠেন।
০৭. সেই স্কুলে পড়ার সময়
সেই স্কুলে পড়ার সময় আমার ডায়েরী ছিল। তাতে লিখতে হতো কবে কি পড়া, কি কি হোম-টাক্স করতে হবে, স্কুলে কবে কোন উৎসব, নানা প্রতিযোগিতায় নাম দেবার দিন, কবে কোন দুটি ইত্যাদি ইত্যাদি এইসব।
দিল্লিতে ডাক্তারী পড়তে এসে এই ধরনের ডায়েরী লেখার দরকার হয়নি।
ছোটবেলা থেকে ব্যক্তিগত ডায়েরী লেখার অভ্যাস খুব কম মানুষের থাকে; তবে বড় হবার পর অনেকেই ডায়েরী লেখেন। তার কারণ বড় হবার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষের মন ডানা মেলে উড়তে শুরু করে। কত কি স্বপ্ন দেখে, কত নতুন নতুন ভাবনা-চিন্তা ভাব-ভালবাসা সুখ-দুঃখের টুকরো টুকরো মেঘ মনের আকাশে আনাগোনা আসা-যাওয়া করে। জমতে থাকে ছোট্ট-ছোট্ট, টুকরো-টুকরো একান্ত ব্যক্তিগত কথা।
যে কথা, যে চিন্তা-ভাবনা-ভাব-ভালোবাসা-সুখ-দুঃখের কথা অন্যের কাছে প্রকাশ করা না গেলেও প্রকাশ করতে মন চায়। সেইজন্যই ব্যক্তিগত ডায়েরীতে সেসব লিপিবদ্ধ করতে মন চায়, ইচ্ছে করে। কোন গোপন কথাই মানুষ চিরদিন নিজের মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে পারে না। অসম্ভব।
যাইহোক আমি যৌবনে পদার্পণ করার পরও আমার মনে তেমন কোন আবেগ বা ভাব-ভালবাসা সুখ-দুঃখের চোরা মেঘ আনাগোনা করেনি। আমার সব ব্যাপারই ছিল খোলামেলা। সব কিছুই ঘটতে প্রকাশ্যে, নানাজনের সামনে। তাছাড়া আমার জীবনের সব চাইতে কাছের, সব চাইতে প্রিয়, সব চাইতে কাম্য যে দুটি নারী, তাঁরা তো মহীয়সী মা-বড়মা। এরাই আমার খেলার সাথী, এরাই, আমার সব চিন্তা ভাবনার অংশীদার। এদের স্পর্শে গন্ধে সান্নিধ্যে আমি আনন্দের মানস সরোবরে ভেসে বেড়াই।
এই দুটি নারীর সঙ্গে আমার একান্ত ঘনিষ্ঠতা, একাত্মতার ব্যাপার কে না জানে?
যে ডায়েরীতে একান্ত নিজস্ব বা গোপন কথা লেখা হয়, সেখানে মা-বড়মাকে টেনে আনা যাবে না।
দিল্লীতে ডাক্তারী পড়তে এসে আলাপ-পরিচয় হলো বহু মেয়ের সঙ্গে। এরা সবাই আমার ব্যাচের ছাত্রী না কিছু মেয়ে আবার দু’এক বছরের সিনিয়র, কিছু মেয়ে আমার পরবর্তী ব্যাচের। তাহোক। এদের অনেকের সঙ্গেই আমার ঘনিষ্ঠতা, হৃদ্যতা ও বন্ধুত্ব। কত হাসি-ঠাট্টা হয় ওদের সঙ্গে।
আজ ডায়েরী লিখতে বসে কত কথা মনে পড়ছে।…
.
একেবারে প্রথম দিনের কথা। প্রথম সাত-দশ দিনের মধ্যেই অধ্যাপক
ডাক্তাররা আমাদের মগজ ধোলাই করে মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন, অ্যানাটমি আর ফিজিওলজি যে যত ভাল জানবে, সে তত ভাল ডাক্তার হবে।
ডাক্তারী যখন পড়তে এসেছি, তখন অবশ্যই ভাল ডাক্তার হতে হবে। তবে সব ছাত্র-ছাত্রীরাই এই ব্যাপারে এক মত কিন্তু…
হ্যাঁ, সত্যিই বেশ বড় একটা কিন্তু আছে। অ্যানাটমি ভাল করে জানতে হলে প্রতিদিন দু’চার ঘণ্টা একাগ্র চিত্তে ডিসেশান করতে হবেই।
ডিসেক্শান?
মানে পচা মড়া কাটা?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, মড়া কাটা। শুনেই অনেক চমকে উঠল কিন্তু পিছিয়ে যাওয়া তো চলবে না।
কিছু ছেলে-মেয়ে জামাকাপড়ে প্রচুর সেন্ট দিয়ে ডিসেশান হল-এ পা দিয়েই নাকে রুমাল দিতে বাধ্য হলো।
সত্যি ডিসেকশান হল-এর গন্ধ সহ্য করা প্রায় দুঃসাধ্য। হল-এর মধ্যে পঁচিশ তিরিশ থেকে পঞ্চাশ-ষাটটা ডেডবড়ি পড়ে থাকে। কোন ডেডবডিই অক্ষত না। ছাত্র-ছাত্রীদের কাটাকুটির কৃপায় এক একটা মৃত দেহের একেক রকম অবস্থা। দেখেই শিউরে উঠতে হয়। তাছাড়া সারা ঘরে অসহ্য বিকট দুর্গন্ধ। সহ্য করতে না পেরে অনেকেই বমি করে। অনেকেই কিছু খেতে পারে না দীর্ঘ দিন।
তবে পচা ভাদরের মেঘও একদিন কেটে যায়। নীল আকাশে টুকরো টুকরো সাদা মেঘ মনের আনন্দে নেচে বেড়ায়। সূর্যের আলোয় ঝলমল করে পৃথিবী। ঠিক সেই রকম মেডিক্যাল ছাত্র-ছাত্রীদেরও ডিসেকশন করার আতঙ্ক ভয় যন্ত্রণা আস্তে আস্তে চলে যায়।
.
হঠাৎ সেদিন আমার ডিসেকশন টেবিলের পাশে এসেই বিপাশা ত্রিপাঠী এক গাল হেসে বলে, শুভ, চলো, চলো, অনেক হয়েছে।
যাস্ট এ মিনিট।
এক মিনিট তো দূরের কথা, দশ-পনের মিনিট পরেও আমি নড়তে পারি না।
বিপাশা গলা চড়িয়ে বলে, সবাই কখন চলে গিয়েছে জানো?
এবার আমি মুখ তুলে দৃষ্টি ঘুরিয়েই বলি, সবাই কখন গেলো? আমি তো টেরও পাইনি।
যাইহোক ডিসেকশান বন্ধু গুছিয়ে হাত ধুয়ে বিপাশার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে আসি।