বুদ্ধদেববাবু একবার দু’হাত জোড় করে সমবেত জনতাকে নমস্কার করেই শিবানী দেবীর বাড়িতে ঢুকে যান।
শিবানী দেবীর হাতে ফুলের বাস্কেট তুলে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, স্টার টি, ভি’তে খবর আর শুভব্রতর ইন্টারভিউ শুনলাম। নিঃসন্দেহে ও অভাবনীয় কৃতিত্ব অর্জন করেছে কিন্তু অনেক বেশি ভাল লেগেছে দেশে থেকে দেশবাসীর সেবা করার সঙ্কল্পর কথা শুনে। ঠিক এই ধরনের ছেলেমেয়েই আজ আমাদের দরকার।
বুদ্ধদেববাবু একটু থেমে বলেন, আর একটা বলে যাই। শুভব্রত যদি পশ্চিমবঙ্গে কাজ করতে চায়, তাহলে ব্যক্তিগতভাবে আমি ও আমাদের সরকার সব রকম সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছি।
শিবানী বলেন, ও ফোন করলেই আমি আপনার কথা জানিয়ে দেব।
মুখ্যমন্ত্রী এবার বলেন, একটা জরুরী আলোচনার মাঝখানেই আমি চলে এসেছি। তাই আমি আর থাকতে পারছি না। এখনই যাচ্ছি। তবে দরকার হলে অফিসে বা বাড়িতে ফোন করবেন।
উনি সবাইকে নমস্কার করে বিদায় নেন। মুখ্যমন্ত্রীচলে যেতেই খবরের কাগজের রিপোর্টার ফটোগ্রাফার আর টি. ভি.-র রিপোর্টার ক্যামেরাম্যানরাও বিদায় নেন কিন্তু বাড়ির সামনে তখন কয়েক হাজার মানুষ। সবার দাবী-মা-বড়মা, জ্যেঠু আর ভাইদাকে দেখব। অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা ওদের প্রণাম করতেও চায়।
যাইহোক আশেপাশের বাড়ির সজল, প্রদীপ্ত, শিখা, তানিয়া আর মাধুরীবৌমার একান্ত অনুরোধে আস্তে আস্তে ভীড় কমতে শুরু করে।
স্নান করে সবাই যখন খেতে বসলো তখন রাত প্রায় একটা বাজে।
তারপরও কি ওদের চোখে ঘুম আসে?
আজ শিবানীর এক পাশে ভারতী, আরেক দিকে দুর্বা। শিবানী বলেন, আমরা সবাই এমন একটা দিনের জন্য এতগুলো বছর অপেক্ষা করছিলাম, তাই নারে ভারতী?
তাতাই সোনা এমনভাবে একটা ইতিহাস সৃষ্টি করে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী থেকে সাধারণ মানুষকে পর্যন্ত মুগ্ধ করবে, তা হয়তো আমরা ভাবিনি কিন্তু ও যে। অসাধারণ কিছু করবে, তা তো আমরা সবাই জানতাম।
দূর্বা বলে, তবে তোমরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবে, বহু পূণ্যের ফলে প্রফেসর রাও-এর মত অসামান্য অধ্যাপকের অমন অভাবনীয় স্নেহ-ভালবাসা পাওয়া যায়।
ভারতী সঙ্গে সঙ্গে বলেন, তবে তাতাই সোনার মত হনুমান ভক্ত ছাত্র পাওয়াও খুব দুর্লভ ব্যাপার।
এইসব টুকটাক কথাবার্তা বলতে বলতেই শিবানী আর ভারতী ঘুমিয়ে পড়েন কিন্তু ঘুম আসে না দুর্বার। জানলা দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে আবছা চাঁদের আলোয় দূরের কৃষ্ণচূড়া গাছ দেখতে দেখতে কত কি মনে হয়। ওর মন ছটফট করে বয়ফ্রেন্ডকে একটু কাছে পাবার জন্য, প্রাণভরে আদর করার জন্য। বার বার বলতে ইচ্ছে করে, বয়ফ্রেন্ড, সত্যি আমি তোমাকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালবাসি। তুমি যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছ, তার জন্য আমার যেমন আনন্দ হচ্ছে, ঠিক সেইরকম গর্ব হচ্ছে।
.
পরদিন কলকাতার সব খবরের কাগজের শুধু প্রথম পাতায় না, অধিকাংশ কাগজেরই প্রথম পাতার প্রধান খবর তাতাইয়ের ইতিহাস সৃষ্টি। সঙ্গে দুতিনটেছবি। স্টেটসম্যান ছেপেছে স্বামীর ছবির সামনে শিবানী। টেলিগ্রাফ খুব বড় করে ছেপেছে মুখ্যমন্ত্রী আর শিবানীর ছবি; আনন্দবাজার আর প্রতিদিন ছেপেছে শিবানীদের সঙ্গে মমতা ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ছবি। সব কাগজেই মোটা মোটা অক্ষরে ছাপা হয়েছে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও মহারাষ্ট্র কর্নাটক অন্ধ্র তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীদের শুভেচ্ছা বার্তা।
।বাবাই আর দুর্বা খবরের কাগজগুলো পড়ছিল; শুনছিলেন সুব্রতবাবু, ভারতী আর শিবানী।
হঠাৎ বাবাই বেশ জোরেই বলে, ও ছোটমা, কাল রাত্তিরেই হস্টেলে গিয়ে ভাইয়াকে অভিনন্দন জানিয়েছেন হেলথ মিনিষ্টার শত্রুঘ্ন সিনহা, তপন সিকদার আর দিল্লির চীফ মিনিষ্টার।
ঠিক সেই সময় শিবানীর ঘরের টেলিফোন বেজে ওঠে।
মা!
তাতাইসোনা!
ছেলের কণ্ঠস্বর শুনেই উত্তেজনায় চিৎকার করে ওঠেন শিবানী।
সবাইকে ডাক দাও।
সবাই এখানে আছে।
সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন টেলিফোনের সামনে।
তাতাই বলে, জ্যেঠু আমার কথা শুনতে পারছো?
সুব্রতবাবু বলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, সবাই শুনতে পারছে।
ও জ্যেঠু দারুণ খবর আছে।
আবার দারুণ খবর?
সুব্রতবাবু উত্তেজিত না হয়ে পারেন না।
তাতাই বোধহয় হাসতে হাসতেই একটু উত্তেজিত হয়ে বলে, প্রেসিডেন্ট ডক্টর কালাম নিজের হাতে চিঠি লিখে আজ রাত্তিরে আমাকে আর স্যারকে ডিনারে নেমন্তন্ন করেছেন।
সবাই এক সঙ্গে বলেন, বলিস কিরে?
হ্যাঁ, জ্যেঠু, আমিও অবাক হয়ে গেছি। তবে উনি তো ভি. ভি. গিরি-ফকরুদ্দীন বা সঞ্জীব রেড্ডীর মতো না; ডক্টর কালাম যে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের সব চাইতে ভাল বন্ধু, তা তো সবাই জানে।
সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
প্রেসিডেন্টের ডেপুটি মিলিটারী সেক্রেটারি কর্নেল ডি’সুজা নিজে এসে এই মাত্র ঐ চিঠি দিয়ে বললেন, আমাকে আর স্যারকে নিয়ে যাবার জন্য আসবেন ঠিক সাতটায়। ডক্টর কালাম ডিনারের আগে অন্তত এক-দেড় ঘণ্টা আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন।
শিবানী বলেন, তাতাই সোনা, তোর সম্মানের কথা যত শুনছি, ততই আমাদের গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে।
বাবাই চিৎকার করে বলে, ভাইয়া, কাল রাত্তিরে ছোট মা-র কাছে বুদ্ধদেব ভট্টচার্য মমতা ব্যানার্জী, সুভাষ চক্রবর্তী, প্রফেসর অম্লান দত্ত থেকে আরো কতজন ছাড়াও হাজার হাজার মানুষ এসেছিল…