হঠাৎ কে যেন আবার ছবি তোলে।
বাবাই তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে ফটোগ্রাফার ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করে, আপনিই কি আগেও ছবি তুলছিলেন?
হ্যাঁ।
কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারছি না।
আমি স্টেটসম্যান থেকে এসেছি।
স্টেটসম্যান?
হ্যাঁ।
বসুন, বসুন।
না, না, আমি বসব না।
স্টেটসম্যানের ফটোগ্রাফার মুহূর্তের জন্য থেমেই বলেন, আমি ঘণ্টা খানেক আগেই অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছি। যেহেতু আমি এই সল্টলেকেই থাকি, তাই অফিস থেকে ফোন করে আপনাদের এখানে আসতে বলল।
আপনি একটু মিষ্টি মুখ না করে…
প্লীজ আমাকে এক্ষুনি অফিসে গিয়ে এই ছবি তৈরি করে দিতে হবে।
উনি সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে যান।
এদিকে টেলিফোনের বিরাম নেই। আবার বাড়ির সামনে লোকে লোকারণ্য!
বাবাই চিৎকার করে, ময়না, বাবার ঘরে টেলিফোন বাজছে শুনতে পাচ্ছো না?
পাড়ার এক মাসীমা বলেন, দুর্বা শিবানীর টেলিফোন অ্যাটেন্ড করছে।
বাবাই এদিক-ওদিক তাকিয়ে গলা চড়িয়ে বলে, এই শিখা, তুই বাবার ঘর থেকে কর্ডলেস আর আমার মোবাইল…
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাবাইদা, ধরছি।
কিন্তু যেভাবে দুটো টেলিফোনই বেজে চলেছে, ও দুটো টেলিফোন সামলাবে কি করে?
শিখা কর্ডলেসে কথা বলতে বলতেই ইসারায় তানিয়াকে ডেকে মোবাইলটা ওর হাতে দেয়।
কতজনের ফোন আসে তার ঠিকঠিকানা নেই। বেথুনের অধ্যক্ষা-লেকচারার প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রী থেকে শুরু করে জানা-অজানা অসংখ্য মানুষের কাছ থেকেও। আরো আরো অনেকের ফোন আসে।
সবাইকেই বলা হয়, বাড়িতে ও বাড়ির সামনে লোকে লোকারণ্য; এখন শিবানী দেবীর পক্ষে কথা বলা অসম্ভব।
এরই মধ্যে পর পর এসে হাজির আনন্দবাজার, টেলিগ্রাফ, প্রতিদিনের রিপোর্টার-ফটোগ্রাফাররা।
হঠাৎ এসে হাজির মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী। উনি শিবানী, ভারতী আর সুব্রতবাবুর গলায় খুব সুন্দর তিনটে মালা পরিয়েই ওদের প্রণাম করে বলেন, আপনাদের ছেলের জন্য আজ সারা দেশের কাছে পশ্চিম বাংলার মুখ উজ্জ্বল হলো। আর সল্টলেকের সবাই মনে করছে, তাদের ঘরের ছেলে ভারত জয় করেছে।
উনি বেরিয়ে যেতে না যেতেই সল্টলেক পৌরসভার চেয়ারম্যান আর অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত এসে হাজির। ওরা বিদায় নিতে না নিতেই বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অম্লান দত্ত রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজির এক দুর্লভ ছবি নিয়ে হাজির। ঐ ছবিটা শিবানী দেবীর হাতে দিয়ে বলেন, চিকিৎসা জগতে শুভব্রত বাঙ্গালির দুর্নাম ঘুচিয়ে এক নয়া নজীর সৃষ্টি করলো। গুরুদেব আর গান্ধীজির এই দুর্লভ ছবিটা ছেলেকে দিয়ে বলবেন, এই দু’জন অসামান্য মহাপুরুষের মতো ওকেও বিশ্বের দরবারে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে হবে।
ঠিক এই মুহূর্তেই সারা ঘর দিনের আলোয় ভরে গেল ছ’সাতটি টি. ভি. ক্যামেরায় ছবি তোলার জন্য।
ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে মিষ্টি বিতরণ। সবার মুখেই মিষ্টি কিন্তু কেউ জানে কারা কিনেছে, কারা দিচ্ছে।
বাড়ির সামনে তখন সব বয়সের হাজার হাজার নারী-পুরুষের ভীড়।
হাজির মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়; হাতে জবা ফুলের মালা ও আরো কি যেন। গাড়ি থেকে নামলেন আরো কয়েকজন। তাদের মধ্যে চারজনের হাতে চারটি হাঁড়ি আর অন্যদের হাতে বিরাট বিরাট ফুলের মালা।
শিবানী আর ভারতাঁকে প্রণাম করে ওদের দুজনের কপালে কালীঘাটের মায়ের সিঁন্দুর দেবার পর মায়ের গলার মালা দেন ওদের হাতে। তারপর দুজনের গলায় বিরাট দুটো মালা পরিয়ে দু’জনের হাতে দু’হাঁড়ি মিষ্টি দিয়ে মমতা বলেন, আজ থেকে আপনারা দুজনে সমস্ত বাঙ্গালী ছেলেমেয়েদের মা-বড়মা হলেন। আর একটা কথা।
ওরা দু’জনেই মমতার মুখের দিকে তাকান।
মমতা বলেন, আজ পশ্চিমবঙ্গের ছেলেমেয়েদের মনে বড় হতাশা; ওরা যেন অন্ধকারের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। শুভব্রত এইসব ছেলেমেয়েদের মনে নতুন আশা জাগিয়ে দিল, ওদের মুখে হাসি আর মনে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে।
মমতা সুব্রতবাবুকে প্রণাম করে গলায় মালা পরিয়ে হাতে মিষ্টির হাঁড়ি দিয়ে বলেন, আজ আপনাদের ছেলে প্রমাণ করে দিল, বড় হতে হলে চাই জ্যেঠু বড়মা, চাই ভাইপো, চাই সংসারে অনেক গুরুজন, অনেক দাদা-দিদি।
ঠিক বলেছেন।
মমতা বাবাইয়ের গলায় মালা আর হাতে মিষ্টির হাঁড়ি দিয়ে বলেন, তুমি কিন্তু আমারও ভাইদা; তোমাকে আমি হাতছাড়া করতে পারব না।
মমতা হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে ভারতী-শিবানীর দিকে তাকিয়ে বলে, ভাইদার বিয়ে হয়নি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, হয়েছে।
দুর্বা পাশেই ছিল। ওকে দেখিয়েই শিবানী বলেন, এই হচ্ছে ভাইদার স্ত্রী।
ওর দু’হাত ধরে মমতা একগাল হেসে বলেন, তার মানে তুমিই শুভব্রতর গার্লফ্রেণ্ড!
দুর্বা এক গাল হেসে বলে, আমি ওর প্রেয়সী, ও আমার বয়ফ্রেন্ড।
মমতা সারা মুখে খুশির হাসি ছড়িয়ে বলেন, একে এই মা-বড়মা, তারপর ওই জ্যেঠু, তার উপর ভাইদা ছাড়াও এইরকম অসাধারণ সুন্দরী প্রেয়সী না পেলে কি শুভব্রত হওয়া যায়?
মমতা চলে যাবার দশ মিনিটের মধ্যেই পুলিশের পাইলট গাড়ির হর্নে মুখরিত হয়ে ওঠে চারদিক। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় এসে থামে শুভব্রতদের বাড়ির সামনে। আগে থেকেই পাঁচ-ছ’জন পুলিশ ছিল বাড়ির সামনে। মুখ্যমন্ত্রী পৌঁছবার কয়েক মিনিট আগেই এক দল পুলিশ নিয়ে এসেছেন এস. পি.। মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি থামার আগেই জিপসীগুলো থেকে লাফ দিয়ে নেমেছে কার্বাইনধারী কমান্ডো বাহিনী। মুখ্যমন্ত্রীর পার্সোনাল সিকিউরিটি অফিসার বিদ্যুত গতিতে গাড়ির সামনে থেকে নেমেই খুলে ধরেন পিছনের দরজা। গাড়ি থেকে নামলেন বুদ্ধদেব ভট্টচার্য। পিছনে এক সিকিউরিটি অফিসারের হাতে সুন্দর এক বাস্কেট ফুল।