ভারতীর কাছে তোমার গানের যে প্রশংসা শুনেছি, তারপর তোমাকে শিল্পী বলে না উপায় নেই।
ভারতী ওকে বলেন, মা, গান শোনাবে না?
দুর্বার মা সুনন্দা দেবী বলেন, গান শোনাতে ময়না সব সময় রাজি। ও তো দিনরাত গান গায়। এমন কি খেতে বসেও…
ভারতী আর শিবানী প্রায় একই সঙ্গে বলেন, ও খেতে বসেও গান গায়?
আমাদের মায়া যখনই ওর সামনে ভাতের থালা আর ডালের বাটি রাখবে, তখনই ও গেয়ে উঠবে…
দুর্বা সঙ্গে সঙ্গে শুরু করে–
কত কাল রবে
বল ভারত রে,
শুধু ডাল ভাত জল
পথ্য করে।
দেশে অন্নজলের হল ঘোর অনটন–
ধর হুইস্কী-সোডা
আর মুর্গি-মটন।…
ভারতী আর শিবানী হো হো করে হেসে ওঠেন।
দুর্বা ওদের দিকে তাকিয়ে বলে, সত্যি, আমি যখন-তখন যেখানে-সেখানে হঠাৎ গান না গেয়ে থাকতে পারি না। এইতো পরশু দিনই ইউনিভার্সিটি গিয়েছিলাম। হঠাৎ দেখি, আমার, তিন-চারটে বন্ধু একটা গাছের ছায়ায় বসে খুব ফিসফিস করছে।
ও হঠাৎ ডান হাতে তুড়ি দিয়েই বলল, ব্যস! আমি হঠাৎ ওদের সামনে হাজির হয়েই গেয়ে উঠি
ওলো সই, ওলো সই
আমার ইচ্ছা করে তোদের মতো
মনের কথা কই।
ছড়িয়ে দিয়ে পা দুখানি
কোনে বসে কানাকানি,
কভু হেসে কভু কেঁদে
চেয়ে বসে রই।
ওলো সই, ওলো সই।
তোদের আছে মনের কথা,
আমার আছে কই।
আমি কী বলিব, কার কথা,
কোন্ সুখ, কোন ব্যথা–
নাই কথা, তবু সাধ
শত কথা কই।
ওলো সই, ওলো সই…
দুর্বার গান শেষ হতেই শিবানী বন্ধুর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলেন, ইন্টারেস্টিং মেয়ে শিল্পী।
হ্যাঁ, তাইতো দেখছি।
ভারতী সঙ্গে সঙ্গেই দুর্বাকে বলেন, এবার হামোনিয়াম বাজিয়ে ভাল করে গান শোনাও।
এবার চলুন আমার ঘরে।
সুনন্দা দেবী বলেন, হ্যাঁ, দিদি, আপনারা ওর ঘরে যান। আপনারা ময়নার গান শুনুন। আমি একটু দোকান থেকে ঘুরে আসি।
দুর্বার ঘরে ঢুকে একবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়েই শিবানী বলেন, হ্যাঁ, শিল্পীর ঘর এই রকমই হওয়া উচিত।
হ্যাঁ, শিবানী, তুই ঠিকই বলেছিস। ভারী সুন্দর রুচিসম্পন্ন করে সাজানো।
মাসীমারা, আপনারা আগে বসুন। অত প্রশংসা করার মতো ঘর আমার না। নিছক একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করি।
হ্যাঁ, ওরা দুজনে দুটো বেতের চেয়ারে পাশাপাশি বসতেই দুর্বা হারমোনিয়াম নিয়ে ওর খাটে বসে। বলে, আপনারা বলুন, কি ধরনের গান শুনতে চান।
দুর্বা সঙ্গে সঙ্গে বলে, আমি কিন্তু শুধু রবীন্দ্রনাথের গানই গাইতে পারি।
সকাল থেকেই মেঘ করেছে। দু’এক পশলা বৃষ্টিও ইতিমধ্যে হয়েছে। এখন আবার মেঘ ডাকতে শুরু করেছে। তাই জানলা দিয়ে একবার আকাশের দিকে তাকিয়েই দুর্বা গেয়ে ওঠে।
এসো হে এসো সজল ঘন
বাদল বরিষনে–
বিপুল তব শ্যামল স্নেহে
এসো হে এ জীবনে।
এসো হে গিরিশিখর চুমি,
ছায়ায়ঘিরি কানন ভূমি
গগন ছেয়েএসো হে তুমি
গভীর গরজনে।…
ভারতী বা শিবানী কোন মন্তব্য করার আগেই দুর্বা আবার শুরু করে–
চিত্ত আমার হারালো আজ
মেঘের মাঝখানে–
কোথায় ছুটে চলেছে সে
কোথায়কে জানে।
বিজুলিতার বীণার তারে
আঘাত করে বারে বারে,
বুকের মাঝে বজ্র বাজে
কী মহাতানে।
চিত্ত আমার হারালো আজ
মেঘের মাঝখানে…
গান শেষ হতেই দুর্বা মুখ তুলে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনাদের ভাল লাগছে তো?
ভারতী বলেন, অপূর্ব।
শিবানী বলেন, সাধে কী তোমার নাম রেখেছি শিল্পী।
দুর্বা বলে, এবার কি পূজা বা প্রেম পর্যায়ের গান গাইব?
শিবানী বলেন, তুমি এবার প্রেম পর্যায়ের গান শোনাও।
ব্যস! দুর্বা গেয়ে ওঠে–
আকাশে আজ কোন্ চরণের
যাওয়া-আসা।
বাতাসে আজ কোন্ পরশের
লাগে হাওয়া ॥…
ঐ গান শেষ হতেই দূর্বা আবার শুরু করে–
আসা-যাওয়ার পথের ধারে
গান গেয়ে মোর কেটেছে দিন।
যাবার বেলায় দেব কারে
বুকের কাছে বাজল যে বীণ।।
সুরগুলি তার নানা ভাগে
রেখে যাব পুষ্পরাগে,
মীড়গুলি তার মেঘের রেখায়
স্বর্ণলেখায় করব বিলীন।।
আসা-যাওয়ার পথের ধারে,
গান গেয়ে মোর কেটেছে দিন…
গান শেষ হতে না হতেই সুনন্দা ঘরে ঢুকলেন। জিজ্ঞেস করেন, ময়নার গান আপনাদের কেমন লাগছে?
ভারতী বলেন, আপনার ময়নার গান শোনার লোভেই তো সল্টলেক থেকে কসবা এলাম।
শিবানী বলেন, আমি তো ভাবছি, আপনার মেয়েকে তুলে নিয়ে যাই।
সুনন্দা একটু হেসে বলেন, হ্যাঁ, স্বচ্ছন্দে তুলে নিয়ে যান কিন্তু একটা ভাল ছেলের সঙ্গে ওকে সাতপাক ঘুরিয়ে দিতে হবে।
ভারতী প্রশ্ন করেন, সত্যি কি মেয়ের বিয়ে দিতে চান?
একশ বার চাই।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, মেয়ের এম. এ. পড়া হয়ে গেল এবার তো মেয়ের বিয়ে দিতেই হবে।
আপনারা পাত্র দেখছেন না?
আসল কথা হচ্ছে, ময়নার বাবাকে কলকাতার একটা আর ফরিদাবাদ হায়দ্রাবাদের দুটো ফ্যাক্টরি দেখতে হয়। উনি মাসে দশ-বারো দিনের বেশি কলকাতাতেই থাকতে পারেন না। তাছাড়া…
তাছাড়া আবার কি?
ময়নার কোন কাকা-জ্যেঠা বা পিসীও নেই যে তারা ওর পাত্রের খোঁজ…
বুঝেছি।
শিবানী সঙ্গে সঙ্গে একটু হেসে বলেন, সুনন্দাদি, আমি কিন্তু ভাল ঘটকালি করতে পারি।
সুনন্দাও হেসে বলেন, ময়নার জন্য ভাল পাত্র দেখে না দিলে কী করে বুঝব আপনি…
ভারতী হাসতে হাসতে বলেন, সুনন্দাদি, ওকে খেপিয়ে দেবেন না। ও হয়তো কালই পাত্র নিয়ে হাজির হবে।