দুর্বাকে দেখেই ভারতী একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, তাতাই চলে যাওয়ায় এমনই মন খারাপ যে আমি আর শিবানী পড়াতে পারিনি।
আমি যে কি করে সারা দুপুর একলা একলা কাটিয়েছি, তাও তোমরা ভাবতে পারবে না। শুধু তাতাইয়ের কথা ভেবেছি।
হ্যাঁ, মা, তা তো হবেই।
একটু পরেই বাবাই ফিরে আসে।
ওকে দেখেই শিবানী বলেন, তুই আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলি?
ছোট মা, তাতাইয়ের জন্য একদম মন ভাল না। আজ কোন কাজে মন লাগেনি। কোনমতে সময় কাটিয়ে চলে এলাম।
কি আশ্চর্য! ছ’টা বাজতে না বাজতেই সুব্রতবাবুও ফিরে এলেন। সবাই অবাক!
দুর্বা প্রশ্ন করে, ছেলে, তোমার কি শরীর ঠিক নেই?
মা জননী, শরীর ঠিকই আছে কিন্তু তাতাই সোনার জন্য…
ওনাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই ভারতী বলেন, সবারই এক অবস্থা।
তবু দিন যায়, যায় দিনের পর দিন। দেখতে দেখতে একটা না, দু-দু’টো মাস কেটে যায়।
.
সেদিন শনিবার।
বাবাই বাড়ি ফিরেছে সাতটা নাগাদ। সুব্রতবাবু এলেন প্রায় পৌনে আটটায়।
বাবাই চা খেয়ে দশ-পনের মিনিট খবরের কাগজের খেলার পাতা দেখেই বাথরুমে গেল স্নান করতে। স্নান করার পর ও ক্লান্তিতে একটু শোয়।
দুর্বা ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলো, কিছু খাবে?
না।
একটু পরেই ভারতী ছেলের ঘরে এসে বলেন, বাবাই, আমি শিবানীর কাছে যাচ্ছি। তোরা খাবার আগে আমাকে ডাক দিস।
আমি টি. ভি. তে একটু খেলা দেখব তুমি ময়নাকে বলে যাও।
হ্যাঁ, ওকেও বলেছি।
যাইহোক আটটা বাজার একটু পরেই বাবাইয়ের মোবাইল বেজে ওঠে।
বাবাই উঠে বসতে বসতেই আপনমনেই বলে, এখন আবার কে ফোন করে? যাইহোক ও নম্বরটা খেয়াল না করেই বোতাম টিপে বলে, হ্যালো।
ওদিক থেকে তারস্বরে চিৎকার করে তাতাই বলে, ভাইদা, আমি এবারও প্রেসিডেন্টস গোল্ড মেডেল পাচ্ছি। একটু আগেই রেজাল্ট বেরল।
বাবাইকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ও উত্তেজিত হয়ে বলে যায়, ন’টায় স্টার নিউজ দেখো। আমি আর প্রফেসর রাও এক্ষুনি ওদের স্টুডিওতে যাচ্ছি। আমাদের ইন্টারভিউ হবে।
তাতাইয়ের কথা শেষ হতেই বাবাই ঘর থেকে ছুটে ছোট মা-র কাছে যেতে যেতে পাগলের মতো চিৎকার করে বলতে শুরু করে, মা! মা! ও ছোটমা! ও বাবা! ভাইয়া আবার প্রেসিডেন্টস গোল্ড মেডেল পাচ্ছে। স্টার নিউজে নটায় ভাইয়ার ইন্টারভিউ।
সুব্রতবাবু বাথরুম থেকে বেরুবার পর পরই বাবাইয়ের চিৎকার শুনেই বাচ্চা ছেলের মতো লাফাতে লাফাতে ও বাড়ি যেতে যেতে সারা পাড়াকে জানিয়ে দেন, আমাদের তাতাইসোনা হ্যাজ ডান ইট এগেন! তাতাইসোনা হ্যাজ ডান ইট এগেন।
ওদিকে আনন্দে খুশিতে শিবানী আর ভারতী চোখের জলের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন।
শিবানী হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতেই ভারতাঁকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ছেলেটা আমার জীবনের সব দুঃখ-কষ্ট আজ দূর করে দিল। আজ আর আমার কোন দুঃখ নেই।
আনন্দে খুশিতে দুর্বা স্তব্ধ। ওর শুধু মনে হচ্ছে, ছুটে গিয়ে তাতাইকে জড়িয়ে ধরতে, আদর করতে।
সুব্রতবাবু শিবানীর ঘরে পা দিয়েই চিৎকার করেন, ও বৌমা, তপুর ছবিতে প্রণাম করে বলল, তাতাই সোনা হ্যাজ ডান ইট এগেন! তাতাই সোনা ওর স্বপ্ন সার্থক করেছে।
হ্যাঁ, শিবানী ছুটে গিয়ে স্বামীর বড় ছবিতে মাথা ঠেকিয়ে ঝর ঝর করে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলেন, ওগো, তোমার তাতাইসোনা আবার প্রেসিডেন্টস গোল্ড মেডেল পাবে। শুধু তোমার আশীর্বাদেই তোমার ছেলে দু’-দু’বার প্রেসিডেন্টস গোল্ড মেডেল পেলো।
ওদিকে বাবাই পাগলের মতো চারদিকে ছোটাছুটি করে চিৎকার করে জানিয়ে দিচ্ছে, ভাইয়া আবার প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল পেয়েছে। ন’টার স্টার নিউজ দেখুন। ভাইয়ার ইন্টারভিউ হবে।
সারা পাড়ার লোক ভেঙে পড়েছে শিবানীর বাড়িতে। ছেলে-মেয়ে বুড়ো বুড়ী সবার মুখেই এক কথা, সত্যি অকল্পনীয়। তাই আমাদের প্রেস্টিজ বাড়িয়ে দিলো।
বাবাইকে হঠাৎ সামনে দেখেই সুব্রতাবু গলা চড়িয়ে বলেন, ওরে, শিগগির টি. ভি. ঠিক কর।
ছোট মা-র ঘরে তো…
ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই সুব্রতবাবু বলেন, ওরে না, না, বৌমার ঘরে না। তপুর ঘরে টি. ভি. থাকবে। তপু স্টার নিউজে ছেলের ইন্টারভিউ শুনবে না?
ও ঘরে তো সবার বসার জায়গা…
সুব্রতবাবু এবার বেশ রেগেই বলেন, ওরে বাবা, আমরা সবাই মেঝেতে বসব।
বাবাই সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশের বাড়ির কয়েকজনের সাহায্যে তপোব্রতর ঘরে টি. ভি. এনে সব ব্যবস্থা করে।
মাঝখানে পাঁচ মিনিট সবাই অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করে। শুধু ঐ ঘরে না, জানলা-দরজার সামনেও অনেকে দাঁড়িয়ে। সুব্রতবাবু হঠাৎ চিৎকার করেন, বাবাই, সাউন্ড খুব জোরে করে দিবি।
বাবাই আগেই স্টার নিউজ চ্যানেল ঠিক করে সাউন্ড অফ করে রাখলো।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, এসে গেছে।
টি. ভি. স্ক্রীনে নিউজ রিডারের ছবি ভেসে উঠতেই সবাই রুদ্ধশ্বাসে সেদিকে তাকিয়ে।…
দিস ইজ স্টার নিউজ-আয়াম সোনিয়া ভর্মা–দ্য হেডলাইন্স : পাকিস্তানী ইনফিলট্রেটর্স হ্যাভ কিলড থার্টি ফাঁইভ মেম্বার্স অব এ ম্যারেজ পার্টি ইন জম্মু ইলেভেন হেভিলি আর্মড টেরোরিস্ট কিলড তামিলনাড়ু প্ৰমালগেটেড অর্ডিনান্স টু চেক অ্যাকটিভিটিজ অব এল. টি. টি. ই. সাপোটার্স ইন্ডিয়া বিট ইংল্যান্ড ইন ফাইন্যাল টেস্ট-রাহুল দ্রাবিড় ম্যান অব দ্য সিরিজ।
সোনিয়া একটু হেসে বলেন, নাউ দেয়ার ইজ এ গুড নিউজ। ডক্টর শুভব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় হাজ ক্রিয়েটেড হিস্ট্রি বাই উইনিং প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল টোয়াইস-ফাস্ট ফর গেটিং রেকর্ড মার্কস ইন সার্জারি ইন দ্য ফাইন্যাল এম. বি. বি. এস অ্যান্ড নাউ ফর টপিং ইন এম. এস. একজামিনেশন অব অল ইন্ডিয়া ইনিস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস।…