পাঁচ-সাত মিনিট পরে ভারতী প্রশ্ন করেন, তুই প্রফেসরের কাছে ক’দিনের ছুটি চেয়েছিলি?
তাতাই একটু হেসে বলে, আমি আসার ব্যাপারে কিছুই বলেনি। প্রফেসর নিজেই আমাকে তিন হাজার টাকা দিয়ে বললেন, এক সপ্তাহের জন্য কলকাতা ঘুরে এসো। আমি জানি, বাড়িতে সবাই তোমাকে একটু কাছে পাবার জন্য হা করে বসে আছেন।
সুব্রতবাবু সঙ্গে সঙ্গে বলেন, উনি তোকে ঠিক নিজের সন্তানের মতোই স্নেহ করেন, তাই না?
জ্যেঠু, তার চাইতেও অনেক বেশি। উনি যে আমাকে কি স্নেহ করেন, কি ভালবাসেন, তা বলা যায় না।
আরো কত কথা হয় খেতে বসে।
ওদের খাওয়া শেষ হবার পর ভারতী আর শিবানী খেতে বসেন। ওদের ঠিক সামনে বসে তাতাই।
একটু পরে দুর্বা এসে ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়ায়।
টুকটাক নানা কথাবার্তার মাঝখানে দুর্বা বলে, আচ্ছা তাতাই, জ্যান্ত মানুষের পেট কাটতে ভাল লাগে?
তোমার ভুড়ি কাটাকুটি করে যে আনন্দ পাবো, তা কি অন্যের পেট কেটে পেতে পারি?
দেখছ বড়মা, ও পদে পদে আমাকে কেমন অপমান করছে?
আমি তোমাকে অপমান করলাম?
আমার পেটকে ভুড়ি বলে…
ওর কথার মাঝখানেই তাতাই বলে, শুধু ভুড়ি না, তুমি একটি আস্ত আড়াই মনি আলুর বস্তা!
তাতাই!
দুর্বা গলা চড়িয়ে বলেই দুহাত দিয়ে ওর মাথার চুল ধরে টান দেয়।
আঃ! কি আরাম! এবার পা দুটো টিপে দাও তো।
পা না, আমি তোমার গলা টিপে দেব।
তা তুমি দিতে পারো। আজকাল তোমাদের মত মেয়েরা হরদম এর ওর গলা টিপে খতম করে সোনা-দানা-টাকাকড়ি নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।
দুর্বা একটু হেসে বলে, বড়মা, দেখছ, তোমাদের আদরের তাতাইসোনা কনন ডয়েল-ফেলুদার চাইতেও বড় গোয়েন্দা হয়েছে।
তাতাই বলে, বড়মা আলতু-ফালতু মেয়ের কথায় কান না দিয়ে আমার কথা শোনো!
হ্যাঁ, বল।
আমি একেক দিন একেক জনের কাছে শোব।
হ্যাঁ, শুবি; তোকে কে বাধা দিচ্ছে?
আজ ভাইদার কাছে, কাল জ্যেঠুর কাছে, মঙ্গল, বুধ তোমাদের দুজনের কাছে, বৃহস্পতি-শুক্র তোমাদের দু’জনের মাঝখানে আর যাবার আগের রাত্রে আবার ভাইদার কাছে…।
দুর্বা মুখ টিপে হেসে বলে, আমার কাছে কবে শোবে?
দিনে-দুপুরে মা-বড়মার সামনেই তুমি আমার গলা টিপে মারতে চাইছিলে; তোমার সঙ্গে রাত কাটাবার আগেই আমার হার্ট অ্যাটাক হবে।
যাইহোক ভারতী-শিবানীর খাওয়া শেষ হতেই তাতাই বাবাইয়ের পাশে শুয়ে পড়ে। দু’জনে টুকটাক কথাবার্তা বলে। একটু পরেই দুর্বা এসে তাতাইকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলে, সরে শোও।
কেন?
আগে একটু সরে যাও; তারপর বলছি।
তাতাই একটু সরে যেতেই দূর্বা ওর পাশে শোয়।
ভাইদা, প্লীজ পুস হার অফ।
ও কি আমার পাশে শুয়েছে যে ওকে আমি সরিয়ে দেব?
হা ভগবান! কি বিপদে পড়লাম! এমন বেহায়া মেয়ে তো আমি জীবনে দেখিনি।
শেষ পর্যন্ত বাবাইয়ের অনুরোধে আবার ওদের যুদ্ধ বিরতি হয়। তিনজনে অনেকক্ষণ গল্পগুজব করে।
তারপর হঠাৎ উঠে পড়েই দুর্বা ডান হাত দিয়ে তাতাইয়ের গাল টিপে আদর করে আর এক গালে চুমু খেয়ে বলে, বয়ফ্রেন্ড গুড নাইট।
.
পুরো একটা সপ্তাহ কি করে যে উড়ে গেল, তা কেউই টের পেলেন না। এই সাতদিন যেন স্বপ্নের মতো কেটে গেল।
রবিবার এয়ারপো।র্ট রওনা হবার আগে তাতাই জ্যেঠু বড়মা আর মাকে দু’হাত দিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে, প্রণাম করে। বলে, সত্যি, প্রাণভরে আনন্দ করলাম এই সাতদিন। তাছাড়া মনের সুখে খেলাম।
ওরা তিনজনেই বলেন, এর মধ্যে যদি আসতে না পারিস, তাহলে রেজাল্ট বেরুবার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের খবর দিবি।
বাবাই আর দুর্বা পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। ওরা তাতাইকে নিয়ে এয়ারপোর্ট যাচ্ছে।
তাতাই হিপ পকেট থেকে পার্স বের করে বলে, মা, বড়মা, দুই মাসীকে ডাক দাও।
দুই মাসী আসতেই তাতাই ওদের হাতে দুশ করে টাকা দিয়ে বলে, তোমরা দারুণ খাইয়েছ।
এবার তাতাই পার্স থেকে দু’শ টাকা বের করে দুর্বার সামনে ধরে বলে, মাসীদের দিলাম আর তোমার মত কাজের মেয়েকে দেব না, তা তো হয় না।
সবাই হো হো করে হেসে ওঠেন।
দুর্বা কোন মতে হাসি থামিয়ে বলে, আচ্ছা বয়ফ্রেন্ড, তুমি কি এখনও আমার পিছনে না লেগে শান্তি পাচ্ছো না?
.
তাতাই চলে যাবার পর সবার মনেই এক বিচিত্র শূন্যতা। সবার মুখেই এক কথা, ও এলে যেন উৎসব শুরু হয়ে যায়। কি আনন্দেই মাতিয়ে রাখে সবাইকে।
দুর্বা বলে, এতদিন শুধু ওর কথা শুনেছি, চিঠি পড়েছি, ছবি দেখছি; তাতেই ওকে ভাল না বেসে থাকতে পারিনি কিন্তু এই এক সপ্তাহ দিন-রাত্তির ওকে কাছে পেয়ে আমি সত্যি পাগল হয়ে গেছি।
ও মুহূর্তের জন্য থেমে বলে, আমি জানতাম ও রূপে গুণে, স্বভাব-চরিত্রে লেখাপড়ায় ওর তুলনা হয় না কিন্তু ও যে এমন করে সবাইকে ভালবাসতে পারে, কাছে টেনে নিতে পারে, তা ভাবতে পারিনি।
ভারতী বলেন, হ্যাঁ, দূর্বা, তুমি ঠিকই বলেছ।
দুর্বা একটু ম্লান হেসে বলে, তাতাইকে যে ভালবাসবে, তার পক্ষে ওকে ছেড়ে থাকা সত্যি খুব কষ্টকর।
শিবানীও একটু ম্লান হেসে বলেন, তাতে আমরা প্রতি মুহূর্তে মর্মে মর্মে উপলবদ্ধি করি।
পরের দিনই সোমবার। ন’টা থেকে সাড়ে ন’টার মধ্যেই সুব্রতবাবু, বাবাই আর ভারতী-শিবানী বেরিয়ে গেলেন। দুর্বা কঁকা বাড়িতে টিকতে পারে না। সারাদিন শুধু তাতাইয়ের কথা ভাবে।
বিকেলের দিকে ভারতী আর শিবানী কলেজ থেকে ফিরে এলেন।