তাই তো জানি কিন্তু…
লক্ষ্মী, বাবা আমার, তুই চোখের জল ফেলিস না। আমি তপুর মৃত্যুর পর তোর মা-র চোখের জল দেখে মাসের পর মাস শান্তিতে ঘুমুতেও পারিনি, খেতেও পারিনি। আমি যতদিন বেঁচে থাকব, তুই কখনই চোখের জল ফেলবি না। আমি তোর চোখের জল সহ্য করতে পারব না।
তাতাই তখনও চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলে, কিন্তু জ্যেঠু, আমি যে ভাবতে পারছি না, ভাইদার বিয়ের ব্যাপারে আমি কিছু জানতেও পারলাম না, করতেও পারলাম না।
তাতাইসোনা, তোকে না জানিয়ে, তোকে কাছে না পেয়ে আমরা যে কি করে বাবাইয়ের বিয়ে দিলাম, তা কি তুই বুঝতে পারছিস না?
সুব্রতবাবু প্রায় না থেমেই বলেন, তুই ভাবতে পারিস, আমরা মাত্র সাতজন বরযাত্রী গিয়েছিলাম? তুই ভাবতে পারিস, বৌভাতের দিন মাত্র চল্লিশ-বিয়াল্লিশ জনকে আসতে বলেছিলাম?
ঐ কথা শুনেই তাতাই যেন দপ করে জ্বলে ওঠে-কেন? ভাইদা কি ভিখিরী? নাকি তোমাদের কারুর কিছু নেই?
তুই ছিলি না বলে…
ওনাকে কথাটা বলতে না দিয়েই তাতাই বলে, ওসব কোন কথা না। ভাইদা কি আবার বিয়ে করবে? ভাইদার কি আবার বৌভাত হবে?
দুর্বা আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ঐ ঘরে ঢুকেই সুব্রতবাবুকে বলে, ছেলে, তুমি যাও। আমি ওর সঙ্গে কথা বলব।
সুব্রতবাবু ঘর থেকে চলে যেতেই দুর্বা তাতাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, তাতাই, আসামী হাজির। আমাকে কি শাস্তি দেবে, দাও।
তাতাই একটি শব্দ উচ্চারণ করে না। শুধু অবাক হয়ে ওকে দেখে।
দুর্বা বলে, তুমি কি জানো, তোমার ছবি দেখে, তোমার কথা শুনে, তোমার চিঠি পড়ে আমি শুধু তোমাকে দেখার জন্য হা করে বসে আছি?
না, তবুও তাতাই কোন কথা বলে না। শুধু অপলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।
তাতাই, তুমি জানো না, তোমাকে আমি কত ভালবাসি। আজ হয়তো বিশ্বাস করবে না, কিন্তু তুমি স্থির জেনে রাখো, আমি তোমার সব চাইতে কাছের, সব চাইতে আপন হবে।
দুর্বা মুহূর্তের জন্য মে বলে, আমার স্থির বিশ্বাস, তুমিও আমাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসবে, আমাকে কাছে টেনে নেবে, আমাকে কখনই তুমি দূরে সরিয়ে দেবে না।
এবার ও একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু হেসে ডান হাত এগিয়ে দিয়ে বলে, আমার সঙ্গে হাল্ড সেক করো।
এতক্ষণ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দুঃখ আক্ষেপ অভিমান আর রাগের পর তাতাই ঠোঁটের কোনে একটু হাসির রেখা ফুটিয়ে ডান হাত এগিয়ে দেয়।
হঠাৎ যেন ঐ ঘরের মধ্যে দিয়ে বসন্তের দমকা হাওয়া বয়ে যায়।
দুর্বা এক গাল খুশির হাসি হেসে দুহাত দিয়ে ওর মুখোনা ধরে দু’গালে চুমু খেয়ে বলে, মাই সুইট বিলাভেড বয়ফ্রেন্ড!
দরজার দু’পাশে দাঁড়িয়ে তারতী আর শিবানী লুকিয়ে লুকিয়ে সব শুনছিলেন, সব দেখছিলেন। এবার আর ওরা খুশি চেপে রাখতে না পেরে ঘরের মধ্যে হাজির হন।
ভারতী তাতাইকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেই বলেন, এই দৃশ্যটা দেখার জন্যই আমরা সবাই হা করে বসেছিলাম। দুর্বা তোকে ঠিকই বলেছে, ও তোর সব চাইতে কাছের মানুষ হবে আর তুইও ওর সবচাইতে প্রিয়জন হবি।
তাতাই একটু হেসে বলে, আমি যুদ্ধ বিরতিতে রাজি হলাম শুধু তোমাদের জন্য; এই শ্ৰীমতীর রূপ দেখে না।
দুর্বা সঙ্গে সঙ্গে তাতাইয়ের দুটো হাত ধরে গেয়ে ওঠে–
আমি রূপে তোমার ভোলাব না।
ভালো বাসায় ভোলাব।
আমি হাত দিয়ে দ্বার খুলব না গো,
গান দিয়ে দ্বার খোলাব।।
তাতাই সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে ওঠে-ও বড়মা, এ তো নটী বিনোদিনীর গুরু।
ওর কথা শুনে শুধু ভারতী আর শিবানী না, দুর্বাও হো হো করে হেসে ওঠে।
০৬. ডাইনিং টেবিলের এক দিকে
ডাইনিং টেবিলের এক দিকে সুব্রতবাবু আর বাবাই বসার পর পরই তাতাই প্রশ্ন করে, আমার পাশে কে বসবে?
শিবানী বলেন, তোর পাশে শিল্পী বসবে।
আমার পাশে বিনোদিনী বসবে?
তাতাই সঙ্গে সঙ্গেই বলে, অসম্ভব! এই অসামান্যা নটীকে পাশে নিয়ে আমি খেতে পারব না।
দুর্বাও সঙ্গে সঙ্গে চাপা হাসি হাসতে হাসতে তাতাইয়ের একটা কান ধরে বলে, আর যদি আমাকে নটী বিনোদিনী বলেছ তাহলে তোমার পিঠে দুম দুম। করে…
তাতাই গলা চড়িয়ে বলে, ও বড়মা, এতে শুধু নটী বিনোদিনী না, এতো আরেক ফুলন দেবী।
ওর কথা শুনে সবাই হেসে ওঠেন।
দুর্বা হাসি থামিয়ে ওকে বলে, আমি তোমাকে সমস্ত মন-প্রাণ-উজাড় করে দিলাম আর তুমি আমাকে…
হোল্ড ইওর টাংগ! ছলনাময়ী।
তাতাই না থেমেই বলে, সমস্ত মন-প্রাণ-হৃদয় দেবে কি করে? আগেই তো ওসব দিয়ে এসেছ তোমার ইহকালের পরকালের বিকাশদাকে।
আবার সবাই হো হো করে হেসে ওঠেন।
দুর্বা কোনমতে হাসি চেপে সুব্রতবাবুর দিকে তাকিয়ে বলে, ছেলে, আমি বলে দিচ্ছি, তোমরা এই অসভ্য ছেলেকে সামলাও; তা না হলে…
ঠিক সেই সময় টেবিলের উপর খাবার দাবার দেখেই তাতাই বলে, এইসব রান্নাবান্না দেখে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এখন যেন কেউ আমাকে বিরক্ত না করে।
কিছুক্ষণ পর সুব্রতবাবু বলেন, হ্যাঁরে তাতাই সোনা, তুই দেড়-দু’মাস থাকবি তো?
না, না জ্যেঠু আমি সামনের রবিবারেই ফিরব।
সে কি?
শিবানী বলেন, মাত্র এক সপ্তাহের জন্য এসেছিস?
হ্যাঁ, তার বেশি থাকার উপায় নেই। প্রফেসর রাও চান না, পাশ করার পর। চাকরি-বাকরি শুরু করার আগে একটা দিনও নষ্ট করি।
ভারতী বলেন, তুই আবার কবে আসবি?
জানি না বড়মা। প্রফেসর পারমিশন না দিলে তো আসতে পারব না।