সুব্রতবাবু বলেন, ওকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়েছিলি তো?
হ্যাঁ, হ্যাঁ।
শিবানী বলেন, তুই এয়ারপোর্ট রওনা হলি কখন?
ওকে হস্টেলে পৌঁছে দিয়ে গেস্ট হাউস ঘুরেই সোজা এয়ারপোর্ট!
সুব্রতবাবু বলেন, তাতাইসোনার পরীক্ষা শেষ হবে কবে?
ভাইয়ার থিওরি পরীক্ষা শেষ হবে সামনের সপ্তাহের বুধবার। তবে কেস স্ট্যাডি আর অপারেশনের প্রাকটিক্যাল কবে হবে, তা পরে জানাবে।
শিবানী বলেন, তার মানে মাস খানেকের আগে শেষ হবে না।
হ্যাঁ, ছোট মা, তা হয়তো লাগবে।
শুধু থিওরি পরীক্ষার পর না, দু’পর্যায়ে প্রাকটিক্যাল পরীক্ষার পরও তাতাই ফোন করে। সবাই জানতে চায় কবে কলকাতা আসছিস?
কিছু ঠিক নেই।
কেন? এখন তো তোদের ছুটি।
ছুটি হলে কি হয়? প্রফেসর রাও ছাড়লে তো?
উনি পারমিশন দিচ্ছেন না কেন?
উনি যেমন পড়াশুনা করাচ্ছেন, সেইরকমই প্রতিদিন আমাদের অপারেশন করতে হচ্ছে।
তার মানে তোর আসার কোন ঠিক নেই।
না।
তাতাই একটু থেমেই বলে, যেদিন প্রফেসর রাও ছাড়বেন সঙ্গে সঙ্গে পালাব। শিবানী বলেন, দেখিস, যদি একটু তাড়াতাড়ি আসতে পারিস। সবাই তোর পথ চেয়ে বসে আছে।
মা, আমি কি তা জানি না? আমি যে মুহূর্তে সুযোগ পাবো, আমি সঙ্গে সঙ্গে রওনা হবো।
কিন্তু তা সত্ত্বেও সাত-দশ দিন তো দূরের কথা, পুরো তিন সপ্তাহ কেটে গেল। তবু তাতাইয়ের দেখা নেই।
.
পরের রবিবার।
খাওয়া-দাওয়ার পর ভারতী শিবানীর কাছে শুয়ে গল্প করছেন। ও বাড়িতে বাবাই আর দুর্বাও খেয়ে দেয়ে নিজেদের ঘরে শুয়ে শুয়ে কথাবার্তা বলছে। সুব্রতবাবু এক সহকর্মীর গৃহ প্রবেশের নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছেন; এখনও ফেরেন নি।
হঠাৎ মনে হলো একটা ট্যাক্সি বা গাড়ি এসে বাড়ির সামনে থামল। তারপরই চিৎকার, ও বড়মা। ও মা! আমি এসে গেছি।
এক লাফে বিছানা থেকে নেমে ভারতী আর শিবানী ছুটে যান তাতাইয়ের গলা শুনে।
তিড়িং করে লাফ দিয়ে ওঠে বাবাইও। বলে, ভাইয়া, এসেছে।
দুর্বা বলে, তুমি ঠিক শুনেছ?
বাবাই একটু হেসে বলে, ভাইয়ার গলা চিনব না?
শিগগির চলো।
না, ময়না, এক্ষুনি ওর সামনে যেতে ভয় করছে। মা আর ছোট মা আগে ওকে একটু সামলে নিন। তারপর আমি যাবো।
বাবাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কি করে যে ভাইয়াকে মুখ দেখাব, তা ভেবে পাচ্ছি না।
তুমি না যাও আমি যাচ্ছি।
ময়না, এক্ষুনি যেও না; একটু পরে যাও।
আমার মনে হয়, যত তাড়াতাড়ি ওকে ফেস করা যায় ততই ভালো।
আমি জানি কিন্তু ফাস্ট স্টীমটা বেরিয়ে যাক। তারপর আমরা যাবো।
দুর্বা আর কোন কথা বলে না কিন্তু স্থির থাকতে পারে না। একবার এই ঘর, আরেকবার ঐ ঘরের জানলায় সামনে দাঁড়িয়ে ও বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে।
এইভাবে কয়েক মিনিট কাটার পরই ও বলে, আমি আর দেরি করব না; অমি যাচ্ছি।
ও বাড়ির ড্রইংরুমে পা দিয়ে এক পা এগুতেই দুর্বা থমকে দাঁড়ায়।
ওর কানে আসে-কি বললে বড়মা? মেয়েটিকে দেখতে খুব ভালো?
হ্যাঁ, বাবা, সত্যি মেয়েটিকে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।
বড়মা, পৃথিবীতে আর সুন্দরী মেয়ে নেই? নাকি এই রাজকন্যাই একমাত্র সুন্দরী?
তাতাই না থেমেই বেশ গলা চড়িয়ে বলে, ভাইদা কি কানা-খোঁড়া? নাকি দেখতে খারাপ? ভাইদা কি মূর্খ নাকি বেকার? নাকি ভাইদা নেশাখোর, লম্পট, চরিত্রহীন?
তা কেন হবে?
ভাইদাকে বিয়ে করার জন্য হাজার হাজার সুন্দরী মেয়ে লাইন দেবে। ভাইদাকে বিয়ে করে যে কোন মেয়ে ধন্য হবে।
না, ভারতী বা শিবানী কোন কথা বলেন না।
আমাকে বললে না কেন? কত সুন্দরী ভাল ভাল ডাক্তার মেয়ের সঙ্গে আমার আলাপ আছে। আমি তাদের কাউকে পছন্দ করে ভাইদার সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করতাম। কিন্তু তোমরা কি করে আমাকে না জানিয়ে…
বললাম তো বাবা, পরীক্ষার আগে তোর মন বিক্ষিপ্ত হবে বলে আমরা জানাতে পারিনি।
এসব কথা আমাকে বলো না; এসব কথা শুনে আমার মন ভুলবে না।
ভারতী দু’হাত দিয়ে ওর মুখোনা ধরে বলেন, তাতাইসোনা, তুই মেয়েটাকে দেখ; নিশ্চয়ই তোর ভাল লাগবে। তাছাড়া ওর গান শুনলে তোর মন ভরে যাবে।
না, না, আমি ওকে দেখতেও চাই না, গানও শুনতে চাই না। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু সী হার ফেস।
তুই তোর ভাইদার বউকে না দেখে থাকতে পারবি?
থাকা উচিত না কিন্তু থাকতেই হবে। তোমার পুত্রবধূর সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
শিবানী বলেন, তাতাই সোনা, ঐ মেয়েটার তো কোন দোষ নেই। ও নিজে তো বিয়ে করতে চায়নি আমরাই চেয়েছি ওকে আপন করে নিতে।
উনি না থেমেই বলেন, তুই শুধু শুধু ওকে দুঃখ দিবি কেন?
ঠিক সেইসময় সুব্রতবাবু ড্রইংরুমে ঢুকেই দুর্বাকে দেখে বলেন, তাতাই এসেছে?
দুর্বা সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখের সামনে হাত নিয়ে বলে, চুপ। তাতাই এসেছে। যেমন রেগেছে, তেমনই দুঃখ পেয়েছে। বড়মা-ছোটমাকে কত কি বলছে।
সুব্রতবাবু খুব চাপা গলায় বলেন, তুমি ভিতরে যাওনি কেন?
আমার উপরই তো যত রাগ।
ঠিক আছে, আমি দেখছি।
সুব্রতবাবু ওর ঘরে ঢুকতেই তাতাই ছুটে এসে ওনাকে জড়িয়ে ধরেই কঁদতে কাঁদতে বলে, জ্যেঠু, তোমরা একি করলে? আমি কি তোমাদের কেউ না? বড়মার পেটে হইনি বলে কি আমি ভাইদার ভাই না? আমি তো তোমার আর বড়মার মাঝখানে শুয়ে বড় হয়েছি। আমাকে তোমরা এভাবে দূরে সরিয়ে…
উনি ওর মাথার উপর মুখ রেখে বলেন, তুই স্বপ্নেও ভাবতে পারিস আমরা তোকে দূরে সরিয়ে দেব? তুই যে আমাদের এক টুকরো স্বপ্ন, তা কি জানিস না?