সুব্রতবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, দরকার হলে আমি ওর কাছে ক্ষমা চাইব। যত রাগ-দুঃখ অভিমানই হোক ও তো আমাদের দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না। আমরাও ওকে ছাড়া বাঁচব না।
.
হ্যাঁ, পঁচিশে শ্রাবণই রাত্রি ৮টা ২৩ মি ৩২ সেকেন্ড গতে শ্রীমতী ভারতী ও শ্রী সুব্রত সরকারের একমাত্র পুত্র শ্রীমান দেবব্রতর সঙ্গে শ্রীমতী সুনন্দা ও শ্রীমানবেন্দ্র চৌধুরীর একমাত্র কন্যা কল্যাণীয়া দুর্বার শুভ পরিণয় সুসম্পন্ন হলো।
পরের দিন সন্ধের পর দেবব্রত তার নব পরিণীতা স্ত্রী দূর্বাকে নিয়ে এলো নিজেদের বাস ভবনে। কিছু আচার-অনুষ্ঠানের পর দুর্বা কালরাত্রি যাপনের জন্য গেল শিবানীর বাড়ি।
ব্যস! সঙ্গে সঙ্গে দুর্বা শিবানীকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
ছোট মা, কি করে যে বিয়ে হলো, তুমি ভাবতে পারবে না। মালাবদলের সময়েও আমাদের দুজনের মুখে হাসি ছিল না। বাসর ঘরে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তোমাদের ছেলে কান্নায় ভেঙে পড়লো। আমি একটি শব্দ উচ্চারণ না করে শুধু চোখের জল ফেললাম।
ও একবার নিঃশ্বাস নিয়েই বলে, ছোট মা, কি করে তাতাইয়ের কাছে মুখ, দেখাবো? সে যদি আমাকে মেনে না নেয়, তাহলে আমি কি করে সংসার করবো?
মা, আজকের দিনে অমন করে চোখের জল ফেলতে সেই। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।
একটু আগেই সুব্রতবাবু আর ভারতী এসে ওদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
সুব্রতবাবু বলেন, মা জননী, তাতাই সোনার সব রাগ-দুঃখ-অভিমান আমি আমার বুকের মধ্যে টেনে নেব। আমাদের এই পাগলা ছেলে কখনই তোমাকে দূরে সরিয়ে রাখবে না।
এত দুঃখ-কষ্ট-চোখের জল সত্ত্বেও সময় নির্মম উদাসীন বাউলের একতারা বাজিয়ে হাসতে হাসতে এগিয়ে যায়। বৌভাত ফুলশয্যাও হয় যথারীতি। চৌধুরী দম্পতিও লন্ডনের পথে দমদম থেকে দিল্লী রওনা হন। দু’চারদিন পর কর্মজীবন শুরু হয় সবারই। মাসী ঘুমুচ্ছে; জেগে আছে শুধু দুর্বা।
না, ওর চোখে ঘুম নেই। কখনও চিত হয়ে শুয়ে কখনও উপুড় হয়ে; কখনও কখনও শুয়ে থাকতে পারে না। ঝম ঝম করে বৃষ্টি শুরু হলেই জানলার ধারে দাঁড়ায়। আবার কখনও কখনও জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় বাইরে। বৃষ্টিতে হাত ভিজে যায়। আগে কত ভাল লাগতো বৃষ্টি দেখতে, বৃষ্টিতে ভিজতে। আর এখন? মনে হচ্ছে, প্রকৃতি যেন ওরই মতো বিষণ্ণ; তাইতো চোখের জলে ভাসিয়ে দিচ্ছেন ধরিত্রীকে।
আগে বৃষ্টি শুরু হলেই দুর্বা কত গান গাইতো কিন্তু বিয়ের দিন ঠিক হবার পর থেকেই ওর কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেছে। একটি গানও গাইতে পারে না। ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের অনুরোধ-উপরোধ পীড়াপীড়িতেও বাসরে কিছুতেই একটা গানও গাইতে পারেনি। না, এখানে এসেও কাউকে গান শোনায়ানি।
কিন্তু কি আশ্চর্য। আজ এই বর্ষণকান্ত ভাদ্রের অপরাহ্নে দুর্বা গুন গুন করে গেয়ে ওঠে–
না যদি বা এলে তুমি
এড়িয়ে যাবে তাই বলে?
অন্তরেতে নাই কি তুমি
সামনে আমার নাই বলে।…
অফিস থেকে ফিরে বাড়ির মধ্যে না ঢুকেই বাইরে দাঁড়িয়েই বাবাই চিৎকার করে, ও ছোট মা! ছোট মা!
শিবানী তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে বলেন, কিরে, অত চিৎকার করে ডাকছিস কেন?
ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটা টিকিট ডান হাতে উঁচু করে ধরে একটু হেসে বলে, আয়াম ফ্লাইং টু ডেলহি অন সানডে।,
হঠাৎ দিল্লী যাবি কেন?
আমার ভাইয়ার ফাইন্যাল এম. এস. পরীক্ষা শুরু হচ্ছে সোমবার; আমাকে সেদিন ওর কাছে থাকতে হবে না?
ওর চিৎকার শুনে ভারতী আর দুবাও বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। ভারতী বলেন, তোকে তাতাই সোনা ফোন করেছিল বুঝি?
তবে কি তোমাকে বা ছোটমাকে করবে?
বাবাই হাসতে হাসতে বলে, তোমরা যতই তাতাই সোনা তাতাই সোনা করো, ভাইয়া তোমাদের চাইতে আমাকে অনেক বেশি ভালবাসে।
শিবানী একটু হেসে বলেন, তার জন্য আমরা কি তোকে হিংসা করবো?
উনি না থেমেই বলেন, ও তোকে কখন ফোন করেছিল?
আর বলো না। ঠিক অফিস থেকে বেরুবার কয়েক মিনিট আগেই ফোন করেছিল। ওর ফোন পাবার সঙ্গে সঙ্গে অফিস ম্যানেজারকে বলে আমাদের ট্রাভেলিং এজেন্টকে দিয়ে রিটার্ন টিকিটের ব্যবস্থা করে…
ভারতী বলেন, ওর পরীক্ষা শেষ হবে কবে?
ভাইয়াও আমাকে বলেনি, আমিও কিছু জিজ্ঞেস করিনি। ফার্স্ট পরীক্ষা শুরুর খবর দিয়েই ও ফোন ছেড়ে দিল।
ও নিশ্চয়ই খুব ব্যস্ত ছিল।
হ্যাঁ, তাই হবে।
শিবানী বলেন, এবার হাত-মুখ ধুয়ে চা-টা খা; আমি আসছি।
হ্যাঁ, চা খেতে খেতেই বাবাই মা আর ছোটমাকে বলে, আমি সোমবার থাকব না বলে রবিবার আমাকে অফিসে যেতেই হবে। তোমরা যা নির্মল্য-পূজার প্রসাদ দেবে, তা ঠিক করে রেখো। আমি অফিস থেকে এয়ারপোর্ট যাবার পথে…
ভারতী বলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা সব ঠিক করে রাখব।
চা-টা খেয়েই বাবাই ক্লান্তিতে একটু শুয়ে পড়ে। পাঁচ-দশ মিনিট পর দুর্বা ঘরে ঢুকতেই ও বলে, কাল তুমি একটা কাজ করবে?
বলো কি করতে হবে।
তুমি পার্ক স্ট্রীটের গিগিল চেনো?
খুব চিনি। বন্ধুদের সঙ্গে ঐ দোকানে অনেকবার গিয়েছি।
খুব ভাল কথা।
বাবাই না থেমেই বলে, পার্কারের সব চাইতে ভাল দুটো কলম কিনতে হবে।
দুর্বা একটু হেসে বলে, তাতাইকে দেবে?
হ্যাঁ।
বাবাই একটু হেসে বলে, আমার দেওয়া নতুন কলম দিয়েই ভাইয়া হায়ার সেকেন্ডারী আর এম. বি. বি. এস ফাইন্যাল পরীক্ষা দিয়েছে।