বলছি, বলছি।
মিঃ চৌধুরী মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, আমি কাল বিকেলেই লন্ডন থেকে ফ্যাক্স পেলাম কবে রওনা হতে হবে। বাংলা ক্যালেন্ডারের সঙ্গে সেই তারিখ মিলিয়ে দেখলাম, ২৯শে শ্রাবণ রাত্রে আমাদের রওনা হতে হবে।
ভারতী আর শিবানী দৃষ্টি বিনিময় করেন। সুব্রতবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, আই সী।
দাদা, আমি অফিস থেকেই আমাদের পুরোহিতের কাছে যাই। উনি বললেন, ২৩শে ও ২৫শে বিয়ের দিন আছে।
একটু ভেবেই সুব্রতবাবু বলেন, তার মানে অগাস্ট মাসের পাঁচ-সাত বা আট ন’ তারিখ হবে।
হ্যাঁ, দাদা, ঠিক বলেছেন।
সুব্রতবাবু খুব জোরে নিঃশ্বাস নিয়েই বলেন, তাতাই সোনার ফাইন্যাল পরীক্ষা শুরু হবে বোধহয় তার কয়েক দিনের মধ্যেই। সুতরাং সে সময় বিয়ে হলে ওর পক্ষে আসা কোনমতেই সম্ভব হবে না অথচ…
সুব্রতবাবু কথাটা শেষ করেন না, শেষ করতে পারেন না।
সুনন্দা বলে, দাদা, আমরাও খুব ভাল করে বুঝি যে তাতাই না থাকলে এই বিয়ের কথা আপনারা ভাবতে পারেন না।
হ্যাঁ, বৌমা, ঠিকই বলেছ।
আমাদের দুজনের চাইতে ময়না আরো ভাল করে জানে, তাতাইয়ের অনুপস্থিতিতে ওদের বিয়ে হতে পারে না। তাইতো ও আমাকে বলছিল, তোমরা চলে যাও, আমি ছোট মা-র কাছে থাকব। ছোট মা আমার বিয়ে দিয়ে দেবেন।
সেই শুনে সুব্রতবাবু আর ভারতী-শিবানীও না হেসে পারেন না।
সুব্রতবাবু বলেন, না, বৌমা, তা হয় না। হাজার হোক মা জননী আপনাদের একমাত্র মেয়ে। আপনাদের অনুপস্থিতিতে কখনই ওর বিয়ে হতে পারে না।
মিঃ চৌধুরী ওনার দুটো হাত ধরে বলেন, দাদা, আপনি বলুন কি করা যায়। আমরা তো ভেবে কোন কুলকিনারা পাচ্ছি না।
ভাই, আমরাও খুব চিন্তায় পড়লাম। এক্ষুনি আপনাকে কিছু বলতে পারছি না। আমাদের কয়েক দিন সময় দিন। আমরা আলাপ আলোচনা করে দেখি, কি করা যায়।
কিন্তু দাদা, হাতে সময় খুব কম।
হ্যাঁ, তাও জানি কিন্তু আমরা নিজেদের মধ্যে একটু কথা না বলে তো…
হ্যাঁ, দাদা, নিশ্চয়ই আপনারা আলোচনা করুন।
আপনি চিন্তা করবেন না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনাকে আমাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেব।
কফি-টফি খেয়ে মিঃ চৌধুরী ও সুনন্দা বিদায় নেবার পরই সুব্রতবাবু শিবানীর দিকে তাকিয়ে বলেন, বলো তো বৌমা, কি অদ্ভুত সমস্যায় পড়লাম। তাতাই সোনাকে বাদ দিয়ে বাবাইয়ের বিয়ের কথা তো আমি ভাবতেই পারি না।
উনি না থেমেই বলেন, বাবাইয়ের বিয়ের সবকিছুই তো ও করবে, আমরা শুধু পিছনে থাকব।
শিবানী বলেন, ওরাও খুবই সমস্যায় পড়েছেন।
ভারতী বলেন, বাবাই এইসব শুনলে তো সোজা বলে দেবে, ভাইয়া ছাড়া এই বিয়ে হতে পারে না।
সুব্রতবাবু বলেন, তা তো বলবেই।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, বিয়ের খবর শুনলেই তাতাই সোনা আনন্দে খুশিতে পাগল হয়ে যাবে কিন্তু ফাইন্যাল পরীক্ষার ঠিক আগে আগেই ওকে এই খবর জানালে ওর সত্যি খুব ক্ষতি হবে।
শিবানী বলেন, হ্যাঁ, দাদা, ওর মন তখন বিয়ের ব্যাপারেই নেচে উঠবে ও কিছুতেই পড়াশুনায় মন বসাতে পারবে না।
ভারতী বলেন, না, না, আমরা তাতাই সোনার এই ক্ষতি করতে পারি না।
ঠিক সেই সময় টেলিফোন।
.
রিসিভার হাতে না নিয়েই শিবানী বলেন, হ্যালো ও শিল্পী তুমি!
হ্যাঁ, ছোট মা, আমি। মা-বাবা কি এখনও তোমাদের ওখানে আছেন?
না, মা; ওরা মিনিট দশেক আগেই রওনা হয়েছেন।
মা কি বলেছে, বিয়ের ব্যাপারে আমি কি বলেছি?
শিবানী একটু হেসে বলেন, তুমি আমার কাছে থাকবে আর তাতাইয়ের পরীক্ষার পর…।
হ্যাঁ, ছোট মা, আমি এই কথাই বলেছি।
সুব্রতবাব বলেন, মা জননী, তুমি মা-বাবার একমাত্র সন্তান। তারা নিজে থেকে তোমার বিয়ে দেবেন না, তাই কি হতে পারে?
ছেলে, তুমি বলো, কেন হতে পারে না।
দুর্বা না থেমেই বলে যায়, আমি এত বছর মা-বাবার কাছে থাকলাম কিন্তু বাকি জীবন তো তোমাদের সবাইকে নিয়ে কাটাতে হবে। আমি তাতাইকে দুঃখ দিয়ে কি শান্তিতে সংসার করতে পারবো?
ও বোধ হয় কাঁদতে কাঁদতেই বলে, না, ছেলে, তোমাদের কাউকে দুঃখ দিয়ে বিয়ে করতে পারবো না।
ভারতী বলেন, ওরে পাগলী মেয়ে, তুমি যে আমাদের কাউকে দুঃখ দিতে পারবে না, তা আমরা খুব ভাল করেই জানি। প্লীজ তুমি কান্নাকাটি বা দুঃখ করো না। যাহোক একটা রাস্তা তো বের করতেই হবে।
আমার কিছু ভাল লাগছে না। তুমি ছোট মাকে বলল, আমাকে নিয়ে যেতে।
সুব্রতবাবু বলেন, মা জননী, শুধু তোমার ছোট মা না, আমরা সবাই তোমাকে নিয়ে আসব।
না, দুর্বা আর কোন কথা বলে না।
.
সুব্রতবাবু শিবানীকে বলেন, বৌমা, এই মেয়েটা আমাদের সবাইকে কি ভালবাসে, তা দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি।
হ্যাঁ, দাদা, মেয়েটা সত্যি খুব ভাল।
সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত ওরা এই বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। বাবাইও ছিল। ও খুব বেশি কথা বলেনি; তবু বলেছিল, দুর্বা বোধহয় ঠিক কথাই বলেছিল ওর মাকে। ও তোমাদের সঙ্গে মেলামেশা করে খুব ভাল করেই বুঝেছে, ভাইয়ার। অনুপস্থিতিতে আমার বিয়ের কথা কেউ ভাবতেও পারে না।
বাবাই মুহূর্তের জন্য থেমে বলেছিল, যাইহোক তোমরা চিন্তা-ভাবনা করে দেখো কি করবে আমি যাচ্ছি।
পরের দিন শুধু সুব্রতবাবু না, ভারতী আর শিবানীও অসুস্থতার অজুহাতে কামাই করে বাড়িতে রইলেন শুধু বিয়ের ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নিতে। ওরা আলোচনা করলেন সকাল-দুপুর-বিকেলসন্ধে। শেষ পর্যন্ত তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওরা রাত নটা নাগাদ সিদ্ধান্ত নিলেন, পঁচিশে শ্রাবণই বিয়ে হবে। তারপর তাতাইয়ের পরীক্ষা শেষ হবার পর ওকে শুধু সব কথা বলা হবে না, সব দোষ নিজেদের ঘাড়ে নেওয়া হবে।