মিঃ চৌধুরী বলেন, দিদি, ও ঠিকই বলেছে।
শিবানী আবার বলেন, তাতাই সোনা হচ্ছে বাবাই সোনার অন্ধ ভক্ত। ও ওর ভাইদাকে যেমন পড়াশুনা পরিশ্রম করতে দেখেছে, ও নিজেও ঠিক সেইরকম…
মিঃ চৌধুরী একটু হেসে বলেন, ও বুঝি দেবব্রতকে খুব ভালবাসে?
ভারতী হাসতে হাসতে বলেন, খুব ভালবাসে বললে কিছুই বলা হয় না। বাবাই সোনা ওর ফ্রেন্ড-ফিলজফার অ্যান্ড গাইড। বাবাই যা যা পছন্দ করে, ও ঠিক তাই পছন্দ করে।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, ভাইদার গলা জড়িয়ে না শুয়ে ও কোনদিন ঘুমুতেও পারতো না।
সুনন্দা একটু হেসে বলেন, তার মানে ওরা দুজনে একেবারে জগাই-মাধাই।
শিবানী একটু হেসে বলেন, তার চাইতেও বেশি।
হঠাৎ সারদা এসে বলে, আপনারা কি শুধুই গল্প করবেন? খাওয়া-দাওয়া করবেন না?
ভারতী আর শিবানী একই সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, চলো।
খেতে বসার আগে ডাইনিং টেবিলের সামনে এসেই সুনন্দা বলে, আচ্ছা তোমরা কি করেছ বলো তো? এত কিছু রান্না করার কোন মানে হয়?
শিবানী বলেন, আমাদের ভাই আজ প্রথম এলো আর তার জন্য একটু ভাল মন্দ রান্না করা হবে না?
দুর্বা সঙ্গে সঙ্গে বলে, ও ছোট মা, সব রান্নাবান্নাই বাবার জন্য আমার জন্য কিছু হয়নি?
সুব্রতবাবু বলেন, মা জননী, আসলে, সবকিছুই হয়েছে তোমার জন্য; তোমার বাবা যেহেতু এসে পড়েছেন, তাই তাকেও একটু ভাগ দেওয়া হবে।
ছেলে, তুমি ঠিক বলেছ। আমি তো দেখছি, সবই আমার পছন্দ মতো হয়েছে।
যাইহোক খেতে বসেও নানা কথাবার্তা হয়।
মিঃ চৌধুরী সুব্রতবাবুর দিকে তাকিয়ে বলেন, জানেন দাদা, ময়না এম. এ. পড়তে শুরু করার পরও আমরা ওর বিয়ে নিয়ে কোন চিন্তা-ভাবনা করিনি কিন্তু ও ফাইন্যাল ইয়ারে উঠতেই সুনন্দা মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে উঠলো।
হ্যাঁ, বৌমা বলেছেন।
বিশাখাপত্তনমে একটি আই-এ-এস ছেলেকে আমার খুব পছন্দ হয়েছিল…
শিবানী ওনার কথার মাঝখানেই বলেন, আমাদের সবাইকে দুঃখ দিয়ে শিল্পী কি করে ঐসব ছেলেদের কাউকে বিয়ে করবে?
মিঃ চৌধুরী একটু হেসে বলেন, যাইহোক দিদি, এমন অপ্রত্যাশিত ভাবে ময়না যে আপনাদের পুত্রবধূ হতে পারবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
সুব্রতবাবু একটু হেসে বলেন, ভুলে যাবেন না, ম্যারেজেস আর হেলড ইন দ্য হেভেন। এ একেবারেই বিধির বিধান।
দাদা, এখন আর তা অস্বীকার করতে পারব না।
উনি সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন করেন, দাদা, বিয়ে কবে নাগাদ হবে, সে বিষয়ে কি কিছু চিন্তা করেছেন?
সুব্রতবাবু সঙ্গে সঙ্গে বলেন, তাতাই সোনার ফাঁইনাল পরীক্ষা আগস্ট, সেপ্টেম্বরের যে কোন সময় হবে; তারপর শীতকালের দিকে মানে মাঘ-ফাঙ্গুনে…
হ্যাঁ, হ্যাঁ, শীতকালে বিয়ে হওয়াই ভাল।
বেশ আনন্দে কাটল সারাদিন। বিকেলবেলায় চা-টা খেয়ে বিদায় নেবার আগে মিঃ চৌধুরী সুব্রতবাবুর দুটি হাত ধরে বলেন, দাদা, আমি দিন দশেক কলকাতায় আছি। আপনি দুই দিদিকে নিয়ে দয়া করে সামনের রবিবার আমাদের ওখানে আসুন। আপনারা এলে আমরা খুব খুশি হব।
আরে ভাই, ওভাবে বলবেন না। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা আসব।
০৫. এই পৃথিবী আবহমান কাল থেকে
এই পৃথিবী আবহমান কাল থেকে ঘুরে চলেছে; এক মুহূর্তের ভগ্নাংশ সময়ের জন্যও এই বিচিত্র বিস্ময়কর পৃথিবীতে যে মানুষের বাস, তাদের অদৃষ্টের চাকাও নিত্য ঘুরে চলেছে সবকিছু তুচ্ছ করে। মানুষের শত অনুরোধ উপরোধ আকুতি মিনতিতেও অদৃষ্টের চাকা এক পলের জন্য থমকে দাঁড়ায় না।
অদৃষ্ট যেমন নির্মম, তেমনই উদাসীন ও রহস্যময়। তার মনের কথা কেউ জানতে পারে না।
সব মানুষই কত হিসেব-নিকেশ করে, কত স্বপ্ন দেখে ভবিষ্যতের কিন্তু অদৃষ্টের নিছক খামখেয়ালীপনায় তা স্রোতের জলে খড়ের কুটোর মত ভেসে যায়। তাইতো অতীত দিনের জমিদারদের উত্তরপুরুষ কলকাতার রাজপথে হকার হয় আবার দীন-দরিদ্রের সন্তান খ্যাতি-যশ-অর্থ-প্রতিপত্তির স্বর্ণশিখর প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়ায়। শত সহস্র কোটি টাকার সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী অর্থের লোভ ও পরমা সুন্দরী যুবতী স্ত্রীর মোহ ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়; আবার কামিনী ও কাঞ্চনের মোহে কত অজস্র মানুষ সর্বস্ব খুইয়ে সারাজীবন হাহাকার করে।
কেউ জানে না কেন একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে গর্ভধারিনীকে সারাজীবন চোখের জল ফেলতে হয় ও বহু সন্তানের জননীকে সন্তানদের মুখে দু’মুঠো অন্ন জোগাবার জন্য দরজায় দরজায় ভিক্ষা করতে হয়।
সব মানুষের জীবনেই কিছু না কিছু অঘটন ঘটবেই। সুখী পরিবারেও কোন কোন সময় ছন্দপতন ঘটবেই। জীবন-পথের সব যাত্রীকেই হোঁচট খেতে হবেই।
.
মাস খানেক পরের কথা।
রাত তখন প্রায় দশটা। একটু আগেই খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়েছে। সুব্রতবাবু শুতে যাবার উদ্যোগ-আয়োজন করছেন। ঠিক সেই সময় টেলিফোন।
হ্যালো দাদা, আমি আপনার মা জননীর বাবা বলছি।
হ্যাঁ, ভাই, বলুন কি ব্যাপার।
দাদা, হঠাৎ একটা গুরুতর সমস্যায় পড়েছি।
সুব্রতবাবু অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হয়ে বলেন, হঠাৎ কোন বিপদ ঘটলো নাকি?
না, তেমন কিছু না।
তবে?
আপনার ও দিদিদের সঙ্গে খুব জরুরী ব্যাপারে আলোচনা করতে চাই।
কি জরুরী ব্যাপার জানতে পারি কি?
দাদা, যখন দেখা হবে, তখন সব কথা বলব।
কবে দেখা করতে চান?
এখন তো রাত হয়েছে; তা নয়তো আজই আলোচনা করতে পারলে ভাল হতো।