দুর্বা সঙ্গে সঙ্গে হাসতে হাসতে বলে, বাবা, তাতাই একটু দুষ্টু না, মহা দুষ্ট ছেলে! ওর কাণ্ডকারখানা শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে।
কেন? ও কি করে?
সুব্রতবাবু সঙ্গে সঙ্গে বলেন, একবার বিকেলবেলার দিকে ও আমাকে বলল, চলো, জ্যেঠু একটু ঘুরে আসি। বৌমাকে বলল, আমাকে নিয়ে একটু বেরুচ্ছে। তারপর কি করলো জানেন?
কী?
আমাকে নিয়ে সোজা পুরী…
মিঃ চৌধুরী অবাক হয়ে বলেন, পুরী? মানে উড়িষ্যার…
হ্যাঁ, হ্যাঁ, উড়িষ্যার পুরী।
বাড়িতে কিছু না জানিয়েই ও আপনাকে পুরী নিয়ে গেল?
হাওড়া স্টেশন থেকে ওর বড়মাকে ফোন করে জানিয়েছিল, আমাকে নিয়ে পুরী যাচ্ছে।
তারপর?
আমরা দুজনেই এক জামা-প্যান্ট পরে বেরিয়েছি। তাছাড়া আমাকে পকেটে একটা পয়সাও নেই।
শুনে অবাক হয়ে চেয়ে থাকেন সুব্রতবাবুর দিকে।
সুব্রতবাবু বলে যান, আমাকে নিয়ে সোজা বি. এন. আর. হোটেলে। তারপর চা খেয়েই বাজারে গিয়ে চার সেট করে পায়জামা পাঞ্জাবি-আন্ডার ওয়ার ছাড়াও রুমাল, টুথব্রাশ-টুথ পেস্ট আর সেভিং সেট কেনা হলো।
কি আশ্চর্য!
বিশ্বাস করুন ভাই, কি আনন্দে আর শান্তিতে যে ওখানে একটা সপ্তাহ কাটিয়েছি, তা বলতে পারবো না।
উনি থামতেই ভারতী একটু হেসে বলেন, এইতো গতবার এসে দুপুরবেলায় খাওয়া-দাওয়ার একটু আগেই তাতাই সোনা বলল, বড়মা, আমি জেঠুকে নিয়ে একটু ঘুরে আসছি।
ভারতী এইটুক বলতেই সুব্রত বাবু বলেন, আমাকে নিয়ে সোজা নিজামে; ওখানে নান আর চাপ খাবার পর নিউ এম্পায়ারের ম্যাটিনী আর লাইট হাউসে ইভনিং শো’তে দুটো খুব ভাল ছবি দেখার পর পার্ক স্ট্রীটে ডিনার…
ফিরলেন কখন?
রাত সাড়ে এগারটায়।
মিঃ চোধুরী সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করেন, ও বললেই আপনি এইরকম বেড়িয়ে পড়েন?
হ্যাঁ, ভাই, ও যা বলে, আমি তাই করি।
সত্যি আশ্চর্যের ব্যাপার।
সুব্রতবাবু একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, আসল কথা কি জানেন ভাই, তাতাই সোনা আমার একটা খেলনা, আমার একটা স্বপ্ন। ওর কোন কথা আমি রাখব না, তা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।
কিন্তু আচ্ছা খামখেয়ালী ছেলে।
কিন্তু ভাই, এই খামখেয়ালী ছেলেটাই এম. বি. বি. এস-এ সার্জারিতে রেকর্ড নম্বর পেয়ে প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল পেয়েছে।
মিঃ চৌধুরী প্রায় অবিশ্বাস্য সুরে বলেন, বলেন, কী? ও প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল পেয়েছে?
হ্যাঁ, ভাই, ও রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক পেয়েছে।
মাই গড! রিয়েলী এ গ্রেট অ্যাচিভমেন্ট।
ভারতী সঙ্গে সঙ্গে বলেন, আমরা তো আশা করছি, তাতাই সেনা এম. এস. পরীক্ষাতেও আবার প্রেসিডেন্টস গোল্ড মেডেল পাবে।
ওদের কথা শেষ হতেই দুর্বা বলে, কবে যে এই পাগলা ছেলেটার সঙ্গে দেখা হবে, আমি শুধু তাই ভাবি। ওকে একটু কাছে পাবার জন্য মন ছটফট করে।
ভারতী হাসতেই বলেন, দুর্বা, তোমার সব দুঃখ ও ঘুচিয়ে দেবে। ও যদি এক জামা-প্যান্টে জ্যেঠুকে নিয়ে পুরী যেতে পারে, তাহলে তোমাকে নিয়ে যে আমার এই ছেলেটা কি করবে, তা শুধু ভগবানই জানেন।
সুনন্দা বলেন, এই শিবানী, এর মধ্যে ছেলের চিঠি এসেছে?
শিবানী কিছু বলার আগেই ভারতী উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাতাই সোনার দুটো চিঠি এসেছে পর পর, আমি সে চিঠি আনছি।
এক মিনিটের মধ্যেই ভারতী দুটো খাম হাতে নিয়ে শিবানীর শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সুনন্দার পাশে বসেই একটু হেসে বলেন, তাতাই সোনার চিঠি পড়ছি।
হ্যাঁ, পড়ো।
প্রথম চিঠিতে লিখেছে-মা-বড়মা মা-বড়মা মা-বড়মা, তোমরা অবিলম্বে একটা বোয়িং এয়ারক্রাফট কিনে আমাকে পাঠাও। আমি রোজ আধ ঘণ্টার জন্য কলকাতা যাবো।
-তোমাদের তাতাই সোনা
সুনন্দা অবাক হয়ে বলেন, ব্যস! চিঠি শেষ?
হ্যাঁ, এই হলো প্রথম চিঠি। পরশু যে চিঠি এসেছে সেটা পড়ছি।…মা, মা, মা, এবার কলকাতায় গেলে তুমি দিনরাত আমার কোলে চড়ে ঘুরে বেড়াবে।
–তোমার তাতাই সোনা।
শুধু সুনন্দা না, সবাই হাসেন।
ভারতী বলেন, এবার আমাকে লেখা চিঠিটা পড়ছি।…বড়মা, বড়মা, বড়মা এক মিনিটের মধ্যে অপারেশন থিয়েটারে যাচ্ছি।
–তোমার তাতাই সোনা।
এত ছোট চিঠি কেউ লেখে?
এত ছোট চিঠি লেখার প্রধান কারণ, সত্যি ও বড্ড ব্যস্ত থাকে। আমার মনে হয়, তাতাই সোনা বোধহয় তিন-চার ঘণ্টার বেশি ঘুমুবারও সময় পায় না।
দুর্বা বলে, বলো কি বড়মা? এত কম ঘুমুলে তোত ওর শরীর খারাপ হয়ে যাবে।
এবার সুব্রতবাবু বলেন, মা জননী, ও পড়াশুনার ব্যাপারে যেমন সিরিয়াস, সেইরকমই সিনসিয়ার।
উনি একটু থেমেই বলেন, ভারত-বিখ্যাত সার্জেন প্রফেসর রাও হচ্ছেন ওখানকার ডীন অব দ্য ফ্যাকাল্টী অব সার্জারি।
মিঃ চৌধুরী সঙ্গে সঙ্গে বলেন, আমি জানি প্রফেসর রাও-এর কথা। সত্যি ওনার মতো সার্জেন বোধহয় আমাদের দেশে আর নেই।
সুব্রতবাবু একটু হেসে বলেন, প্রফেসর রাও-এর মানস পুত্র হচ্ছে তাতাই সোনা। পড়াশুনা, লাইব্রেরী, আউট ডোর বা সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের ডিউটি ছাড়াও প্রফেসর রাও ওকে দিয়ে প্রত্যেক দিন দুতিনটে অপারেশন করাবেনই।
সুনন্দা চোখ দুটো বড় বড় করে বলেন, বাবা! ওকে তো তাহলে সত্যি অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়।
শিবানী একটু হেসে বলেন, তাতাই সোনা কলকাতায় এলেই ভারতী সব সময় ওকে একটু বেশি ঘুমুবার আর ভাল করে খাওয়া দাওয়ার কথা বললেই ও বলবে, ভাল করে খাওয়া-দাওয়া আর ঘুমুবার জন্য সারাজীবন পড়ে আছে।